পথের কুকুর ড্যানি
নীতীশ বসু
বাদামী রঙের একটা কুকুর ঋককে দেখলেই কোথা থেকে যে ছুটে আসে, ঋক বুঝতে পারে না। কিন্তু ওর খুব ভালো লাগে। সপ্তাহে যে পাঁচদিন ও সন্ধের সময় মৃণাল স্যারের কাছে পড়তে যায়, ওই বাদামি রঙের নাদুসনুদুস কুকুরটা ওর সঙ্গে যায়। ঋকের পড়া শেষ না হওয়া পর্যন্ত বাইরে কোথাও অপেক্ষা করে। ঋকের ছুটি হলেই ছুটে আসে আর ঋকের সঙ্গে সঙ্গে বাড়ি পর্যন্ত যায়। তারপর ও ঘরে ঢুকলেই কুকুরটা কোথায় যে চলে যায়, ঋক বুঝতে পারে না। এদিকে এ ব্যাপারে বাড়ির কাউকে কিছু বলার সাহসও পায় না সে।
যেদিন ওর হাতে সময় থাকে, সেদিন ঋক কুকুরটার সঙ্গে খেলা করে, কথা বলে। কুকুরটাও বেশ মজা পায়। ঋক আদর করে ওর নাম দিয়েছে ড্যানি। ওই নামে ডাকলে ও যেখানেই থাকুক না কেন, ঋকের ডাকে ছুটে আসবেই। বেশ ভালই লাগে ঋকের। কুকুরের সঙ্গে কথা বলতে বলতে ঋককে পড়তে যেতে দেখে অনেকেই আশ্চর্য হয়। কেউ কেউ খুশি হয়, কেউ কেউ আবার বলে পথের কুকুর যদি কিছু করে?
ঋক বলে, ও পথের কুকুর বলে বলছেন। কিন্তু এই শহরে অনেক বাড়িতে যারা বিদেশি কুকুর পোষে, তাদের কুকুর ভালো আর ও পথের কুকুর বলে খারাপ?
ওরা আর কিছু বলে না। ঋক ওদের কথার ভ্রুক্ষেপ না করে ড্যানির সঙ্গে কথা বলতে বলতে পড়তে চলে যায়।
ঋক বয়েজ স্কুলে ক্লাস ফাইভে ভর্তি হয়েছিল। এবার ও সিক্সে উঠেছে। ওর মা-বাবা দুজনই এই শহরের নামকরা ডাক্তার। ইচ্ছে করলে নিজেদের গাড়িতে ঋককে স্কুলে বা টিউশনিতে পাঠিয়ে দিতে পারে। কিন্তু ঋকের বাবার কথা, ওকে হেঁটেই যেতে হবে। ওর ঠাম্মা বলে, আরে সন্তু তোর গাড়ি তো হসপিটালে গিয়ে বসেই থাকে। ওকে একটু দিয়ে এলে কি হয়?
ওর বাবার এক কথা, ওকে একটু কষ্ট করে বড় হতে দাও, না হলে ও বুঝতে পারবে না। আর ওর কাছে তো মোবাইল আছে। অসুবিধে হলে ফোন করবে ! এরপর ঠাম্মা আর কিছু বলে না।
বাড়িতে শুধু ঠাম্মা আর পরিচারিকা অনুরাধা মাসি থাকে। অনুরাধা মাসি ওদের বাড়িতেই থাকেন, ওঁর ঘরসংসার নেই। জিজ্ঞেস করলে বলে, ওঁর স্বামী নাকি ওই চাঁদের দেশে। আর একমাত্র ছেলে, সেও নাকি তাঁকে দেখে না। তাই উনি ঋকদের বাড়িতেই থাকেন। জন্মের পর থেকেই ঋক অনুরাধা মাসিকে দেখছে। ঋককে অনুরাধা মাসি খুব ভালোবাসেন, ঋকও অনুরাধা মাসিকে নিজের মাসিই ভাবে। ঠাম্মার সাথে তো ঋকের খুব ভাব। কিন্তু ও কিছুতেই ওই পথের পুকুরটার সম্পর্কে ঠাম্মাকেও কিছু বলতে পারে না। তবে ওর বেশ ভালো লাগে বাদামী রঙের নাদুসনুদুস ড্যানি যখন ওর সঙ্গে যায়, আবার ওর পড়া হয়ে গেলে ঋককে বাড়ি পর্যন্ত পৌঁছে দেয়। ঋক মনে মনে ভাবে কাল যখন ও চলে যাবে, তখন ড্যানির পেছন পেছন গিয়ে দেখবে সে কোথায় থাকে।
আজ ঋক পড়তে যাবার সময় ড্যানিকে দেখতে পেল না। একটু অবাক হলেও ও একা একা চলে গেল পড়তে। মনে মনে ভাবল, ইস আজ ড্যানির সঙ্গে দেখা হলো না। ও আর দেরি না করে মৃণাল স্যারের ঘরে ঢুকে গেল।
পড়া হয়ে গেলে ঋক বাইরে এসে ড্যানিকে দেখে আদর করে বলে, আজ আসিসনি কেন? ও লেজ নেড়ে ঘেউ ঘেউ করে। ঋকও আর কথা না বাড়িয়ে বলে, চল। ড্যানি ঋকের সঙ্গে হাঁটতে থাকে।
ঋক ড্যানিকে বলতে লাগল একদিন তোকে আমাদের বাড়িতে নিয়ে যেতে হবে। ড্যানিও যেন ঘাড় নেড়ে সম্মতি জানায়। এমন সময় হঠাৎ একটা ঘটনা ঘটে। বেপরোয়াভাবে মোটর সাইকেল চালিয়ে ঋককে ধাক্কা দিয়ে একজন ওর হাতের মোবাইল ফোনটা ছিনিয়ে নিয়ে চলে যাচ্ছিল। ঋককে রাস্তায় পড়ে যেতে দেখেই ড্যানি দেরি না করে ছুটে গিয়ে মোটরসাইকেল চালক ছিনতাইকারীকে ধরে ফেলে। এদিকে অনেক চেনা-অচেনা মানুষ ছুটে এল ঋকের কাছে। ওকে তুলতেই ঋক বলল, আমার ফোন নিয়ে গেল। তারপর যারা ওকে তুলেছিল তাদের মধ্যে একজন বলল, আরে ও তো ডাক্তার সামন্তের ছেলে। আমি ডাক্তারবাবুকে ফোন করে বলছি। কেউ আবার ছিনতাইকারীর পেছনে ছুটে গেল। কেউ পুলিশকে ফোন করল।
একটু পরেই ঋকের বাবা এসে গেল আর ঋককে দেখে বলল, এসব কি করে হলো? ঋক বলল, আমাকে মোটরসাইকেলের ছেলেটা ধাক্কা দিয়ে আমার হাত থেকে মোবাইল ফোনটা ছিনিয়ে নিতেই আমি রাস্তায় পড়ে গিয়েছিলাম।
এমন সময় একজন লোক ছুটতে ছুটতে এসে ঋকের বাবাকে দেখে বলল, ডাক্তারবাবু মোটরসাইকেলের ছেলেটিকে ভাগ্যিস একটা কুকুর ধরে ফেলেছিল। না হলে ছেলেটি ফোনটা নিয়ে পালিয়ে যেত। যে কুকুরটা ওর সঙ্গে রোজ যেত, সেই ছুটে গিয়ে ছিনতাইকারীকে মোটরসাইকেলসহ ধরে ফেলেছে। পুলিশকে ফোন করেছি পুলিশ এসে গেছে। এমন সময় ঋক বলে উঠল, আমার ড্যানি? ভিড়ের ভিতর থেকে কে যেন বলে উঠল তোমার সঙ্গে যে রাস্তার কুকুরটা যেত আসত তো ? ও এখানেই আছে।
ঋক ওর বাবাকে বলল, বাবা আমাকে ওর কাছে নিয়ে চল। ঋকের কথা শেষ না হতেই লোকটি বলল, কুকুরটার জন্যই ছিনতাইকারী ছেলেটিকে ধরা গেল। ওখানে পুলিশ এসে গেছে।
ভিড়ের ভেতর থেকে একজন বলে উঠল, স্যার আপনি একটু আমাদের সঙ্গে চলুন। এমন সময় ঋক বলে উঠল, হ্যাঁ বাবা আমার ড্যানি ওখানে আছে। ওকে দেখে যাব। আজ ও যদি আমার পাশে না থাকত, তাহলে তো অনেক কিছুই ঘটতে পারত? ঋকের কথা শুনে বাবা বলল, চল।
পুলিশ ছিনতাইকারী ছেলেটিকে নিয়ে গাড়িতে তুলবে, এমন সময় ডাক্তার সামন্ত স্পটে পৌঁছতেই ড্যানি ছুটে এল ঋকের কাছে। কি যেন বলতে চাইলো। কিন্তু ওর ঘেউ ঘেউ শব্দ ছাড়া কেউ কিছু বুঝতে পারল না।
ঋক শুধু গাড়ির দরজা খুলে বের হয়ে বলল, আমি ভালো আছি। তুই আমার সঙ্গে যাবি?
ঋকের বাবার সঙ্গে পুলিশের কি কথা হলো, ঋক বুঝতে পারলে না। ও শুধু দেখল, মোটর সাইকেলটা একজনকে নিয়ে যেতে বলে ছেলেটিকে পুলিশ গাড়িতে তুলে নিয়ে গেল। ওর বাবা গাড়ির কাছে এসে দেখল একটা কুকুরকে ঋক আগলে ধরে বসে আছে।
বাবা বলল, এই তোর ড্যানি? ওকে বাড়ি নিয়ে চল। এখন থেকে ও আমাদের বাড়িতেই থাকবে।
ঋক ওর বাবার মুখে ড্যানিকে নিয়ে যাওয়া হবে শুনে খুব খুশি হয়ে ওকে বলল, ওঠ গাড়িতে। ওরা চলে যেতেই ভিড় কমতে শুরু করল। সবাই ঋকের কুকুরের প্রশংসা করে বলতে লাগলো একটা পথের কুকুর হয়েও কি করে ঋককে বিপদের মুখ থেকে বাঁচালো। সত্যি ভাবা যায় না। সত্যিই পথের পুকুর এমন হতে পারে আমরা অনেকেই বুঝি না। আমরা ওদের থেকে দূরে থাকি। বরং তাড়িয়ে দিই। এভাবেই পথের কুকুর ড্যানি সবার আলোচনার বিষয় হয়ে গেল।
পাঠকদের মন্তব্য
250