ছোটোদের চাঁদের হাসি / গল্পগাথা / অক্টোবর ২০২৫

বীথির চুপকথা

হুড়মুড়িয়ে বিছানার উপরে উঠে বসলাম। মোবাইলের ঘড়িতে সকাল সোয়া পাঁচটাI শীতকাল, তাই তখনও অন্ধকার কাটেনি। মা ঠেলে উঠিয়ে দিয়ে বললেন, “বীথি, তাড়াতাড়ি ওঠ। জানিস, আমাদের বাগানের দক্ষিণে পুকুরের ধারে করমচা গাছটার ফুট সাতেক দূরে একটা বিশাল গর্ত হয়েছে, আর সেখান থেকে ক্রমাগত হলদেটে সবুজ রঙের হালকা ধোঁয়া বের হচ্ছে। শিউলির বাবা সমীরণবাবু বললেন যে উনি নাকি একটা জ্বলন্ত আগুনের গোলাকে গতকাল ভোর রাতে আমাদের বাগানে পড়তে দেখেছেন। তীব্র আলোয় নাকি চারদিক দিনের বেলার মতো পরিষ্কার দেখা যাচ্ছিল।

 

রাত সাড়ে তিনটে নাগাদ সমীরণবাবু একবার ছাদে উঠেছিলেন বিশেষ প্রয়োজনে। আর ঠিক তখনই একটা বেশ বড় উজ্জ্বল আগুনের গোলাকার বস্তুকে আমাদের বাগানের দক্ষিণ ধারে পুকুরের আশেপাশে বেশ জোরে হুইসেলের মত শব্দ করে আছড়ে পড়তে দেখেন। বেশ একটা বোম পড়ার মতই নাকি আওয়াজও হয়। উনি রীতিমতো ভয় পেয়ে সেই থেকে পাড়ার অনেককেই ফোন করার চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু কেউই অত রাতে ফোন ধরেনি।

 

যাই হোক, পাল’দা প্রথমে ধরেছিলেন। আমাদেরও করেছিলেন, কিন্তু তোর বাবা তো জানিস, রাতে ফোন অফ করে রাখে। ওরা দু’জন এবং আরো অনেকে এসে দেখেন, আমাদের করমচা গাছটার তলায় জটলা। আমিও গেছিলাম, একটা বড় গর্ত হওয়া ছাড়া আর সেরকম কিছু চোখেই পড়লো না। তবে গর্তটা থেকে কেমন যেন হালকা হলদেটে সবুজ রঙের ধোঁয়া বের হচ্ছে। তোর বাবা বললো, যেটা পড়েছে সেই বস্তুটিতে বেরিয়াম ক্লোরাইড জাতীয় কিছু একটা কেমিক্যাল পদার্থ আছে।

 

আমি এক লাফে বিছানা থেকে নেমে চটিটা কোনরকমে পায়ে গলিয়ে দে ছুট। সবাইকে চিৎকার করে বললাম,”এই সরো সরো আমাকে দেখতে দাও।”

 

“আরে বীথি, এতক্ষণে সময় হলো? দ্যাখ কি কান্ড ঘটেছে কাল রাতে। তোরা তো রাতারাতি বিখ্যাত হয়ে গেলি রে”–সমীরণকাকু মজা করে হালকা হেসে বললেন।

 

বোসকাকুও মজার সুরে বললেন, “হ্যাঁ, বীথিকে এখন পায় কে! টিভির সব চ্যানেল বীথির ইন্টারভিউ নেবে। বীথি ভালো করে দেখেশুনে সব বুঝে নে! তোকেই তো সব বুঝিয়ে বলতে হবে। বিভিন্ন দেশ বিদেশের নামীদামী  টিভি চ্যানেলের সাংবাদিকদের।”

 

জায়গাটা দেখে আমি তো এক্কেবারে ‘থ’। খবরে বেশ কয়েক বছর আগে দেখেছিলাম রাশিয়ার কোথায় যেন একটা এই ধরনের উল্কাপাত হয়েছিল। তখন বোধহয় ক্লাস থ্রিতে পড়তাম। অত কিছু বুঝতাম না। কিন্তু সেরকমই কিছু শেষে কিনা আমাদের বাগানে? ভাবতেই কেমন যেন একটা গায়ে কাঁটা দেওয়ার মতো অনুভূতি হচ্ছিল। পাড়ার কাকুরা এবং বাবা মিলে লোকাল থানায় ফোন করেছিলেন। পুলিশ কাকুরা প্রথমেই এসে চারদিক থেকে ভিড় সরিয়ে জায়গাটা চওড়া হলুদ রঙের ফিতে দিয়ে ঘিরে দিলেন এবং বাবাদের কাছ থেকে কে প্রথম দেখেছে, কখন দেখেছে, আকারে কত বড় ছিল–এই ধরনের কিছু প্রশ্ন করে যা শোনার শুনে একটা ডায়েরিতে লিখে নিলেন এবং যিনি অফিসার ছিলেন, বিভিন্ন জায়গায় ফোন করলেন।

 

এর কয়েক ঘন্টার মধ্যেই সরকারি দপ্তরের লোকজন ও বিভিন্ন চ্যানেলের সাংবাদিকরা জায়গাটা পুরোপুরি ঘিরে ফেললো।  সকাল দশটার পর থেকেই বিভিন্ন ভাষার দেশি-বিদেশি টিভি চ্যানেলগুলো ফলাও করে উল্কাপাতের খবর প্রচার করা শুরু করে দিল। এলাকার বিভিন্ন জননেতারাও এসে গেলেন এবং মাইকে এলাকার সমস্ত অধিবাসীদের উদ্দেশ্যে প্রচার করা শুরু করলেন। বক্তব্য এইরকম, এলাকাবাসী সকল জনসাধারণের উদ্দেশ্যে বিশেষ জরুরি সরকারি ঘোষণা। স্থানীয় প্রদ্যুত চ্যাটার্জির বাড়ির বাগানে বিশালাকার মহাজাগতিক বস্তুর আছড়ে পড়ার ঘটনা ঘটেছে। তাই আগামী কয়েকটা দিন প্রত্যেকেই একটু সাবধানে থাকবেন। এই ধরনের কোনো ঘটনা পুনরায় ঘটলে সঙ্গে সঙ্গে লোকাল থানা এবং পার্টির কার্যালয়ে যোগাযোগ করবেন। ভয় পাওয়ার কিছু নেই। টোটাল সিচুয়েশন ইজ ওয়েল আন্ডার কনট্রোল নাউ। কোনোরকম গুজবে কেউ কান দেবেন না বা অকারণ গুজব ছড়াবেন না।

 

ক্লাস সেভেনে পড়া বীথির কানে অবশ্য এসব কিছু প্রবেশ করছিল না। সেদিন ছিল সোমবার, স্কুল খোলা। মাকে স্কুলে যাবো না বলে কোনো লাভ হলো না। “না না, মাথা খারাপ নাকি? স্কুলে যেতেই হবে। স্কুলে একদিন না যাওয়া মানে বিশাল ক্ষতি। আমি আন্টিদের ফোন করে আজকে স্কুলে কি পড়ানো হয়েছে সেটা জানতে পারবো না। আর আজ যা শয়ে শয়ে লোকের আনাগোনা শুরু হয়েছে, তাতে করে আমার মাথাও ঠিক থাকছে না।

 

খানিক আগেই তো একজন মহিলা সাংবাদিক একেবারে রান্নাঘরের ভেতরে ঢুকে এসে জিজ্ঞেস করা শুরু দিলো, বৌদি আপনি এই ব্যাপারে কিছু বলুন। এতবড় একটা ঘটনা, আপনার কি ধরনের অনুভূতি হচ্ছে? আচ্ছা ঠিক কখন ঘটনাটা ঘটেছিল? আচ্ছা, শুনলাম যে একটা বেশ জোরালো হুইসেলের মতো আওয়াজ কানে এসেছিল। আচ্ছা, শব্দটি কেমন ছিল, মানে মাটিতে পড়ার সময় চকলেট বাজির মতো ছিল, নাকি বড়সড় কোনো পেটো, মানে সরি, বোমের মতো ছিল? আচ্ছা ম্যাডাম, সেই সময় কোনো কম্পন কি অনুভব করেছিলেন?  আচ্ছা, আকারটা কত বড় হতে পারে বলে আপনার মনে হয়? এক কিলো নাকি তার থেকে কম?

 

আমি আর থাকতে না পেরে হাত জোড় করে বললাম , “সরি বোন, আমি কিছু দেখিনি। জানি না। তাই আমাকে দয়া করে রান্নাটা করতে দিন। বাইরে অনেকে আছে তাদের জিজ্ঞাসা করুন”–বলে মূল দরজাটা বন্ধ করে দিয়েছি। যত্তসব উটকো ঝামেলা।

 

আমি আর সেই মুহূর্তে মাকে দ্বিতীয়বার বিরক্ত করার সাহস দেখাইনি। কারণ, আমি জানি সেই সময় বেশি বিরক্ত করলে আমার পিঠেই দু-চারটে উল্কাপাত ঘটে যেতে পারে। ধোঁয়া হয়তো বেরোবে না কিন্তু পিঠটা যে জ্বলে যাবে সেটা আমার থেকে বেশি মনে হয় আর কারোর জানার কথা নয়। অগত্যা বাধ্য মেয়ের মতো প্রস্তুতি নিয়ে স্কুলে গেলাম। সেখানেও কি রেহাই আছে? গোটা স্কুলের কোনো একটা মেয়ে বাকি নেই যে অন্তত কম করে দশটা প্রশ্ন করেনি। প্রত্যেক ক্লাসেই দিদিমনিরা দাঁড় করিয়ে হাজার-গন্ডা প্রশ্নবাণে বিদ্ধ  করলেন।

 

টিফিন পিরিয়ডে বড়দিদি তার ঘরে ডেকে নিয়ে গিয়ে আরও ডজন খানেক প্রশ্ন। গোটা দিনে প্রায় হাজার দশেক প্রশ্নের মুখোমুখি হয়ে আমি একেবারে বিধ্বস্ত। বাড়ি ফিরে আর কারো সাথে কথা বলতে ইচ্ছা করছিল না। শুধু মা বললেন, “কিরে আজ ক্লাসে কি কি পড়ানো হলো?” বললাম, সারাদিন শুধু আমাদের বাড়ির উল্টোপাল্টা ঘটনা নিয়ে আলোচনা হয়েছে, আর কিছু হয়নি। মা মনে হলো উত্তরটা শুনে খুশি হলেন না। গজগজ করতে করতে নিজের কাজে চলে গেলেন। যাওয়ার সময় বলে গেলেন, “তোমার ঘরের টেবিলে গ্লাসে দুধ আর প্লেটে কেক দেওয়া আছে, খেয়ে নিও। খেয়ে কিন্তু গ্লাস ও প্লেট দুটোই রান্নাঘরের বেসিনে রেখে আসবে।”

 

বাবাকে বাড়িতে দেখলাম না। তখনও  বেশ কিছু অপরিচিত মুখ বাগানের দক্ষিণ দিকটায় ঘোরাঘুরি করছিল। একবার এগিয়ে যে দেখে আসবো এখনো ধোঁয়া বের  হচ্ছে কিনা, আর ইচ্ছা করলো না। ইস্কুলের পোশাক ছেড়ে ঘরের পোশাক পরে বাথরুমে গিয়ে হাত-পা-মুখে জল দিয়ে ফ্রেশ হয়ে নিলাম। ঘরে গিয়ে আধা ঘন্টা একটু শুতে হবে। দুধ আর কেকটা খেয়ে ঘরের আলোটা নিভিয়ে বিছানায় শুয়ে পড়লাম। মা আর বাবা হলঘরে টিভি চালিয়ে খবর দেখছিলেন। বাংলা, ইংরেজি, হিন্দি সব চ্যানেলেই সেই একই খবর। মা ডাকলেন, “বীথি, একবার দেখে যা। তোর বাবাকে দেখাচ্ছে।”

বাবা বারণ করলেন। “কেন ডাকছো, একটু বিশ্রাম নিচ্ছে, নিতে দাও। সেই কোন সাতসকালে উঠেছে বলো তো ! বাচ্চা মেয়ে, এসব কি বুঝবে। পড়েছে’তো একটা দশ বা বিশ গ্রামের গ্রহাণু। অন্য ধরনের কিছু হলে, কোনো ভিনগ্রহী বা ওরকম কিছু, তাহলে না হয় একটা মনে রাখার মতো বা বলার মতো ঘটনা হতো।”

 

মা ধমক দিয়ে উঠলেন,”তুমি থামো তো। ওইসব জঘন্য দেখতে ঠ্যাংরা কাঠির ওপর আলুর দম এলিয়েন না কি যেন একটা বলে, ওগুলো আমাদের বাগানে নেমে আসুক আর তারপর আমার মেয়েটার একটা ক্ষতি করে দিক। ও সব অলুক্ষণে কথা কখনো মুখেও আনবে না। আমি দেখেছি ছোটবেলায় একটা সিনেমায়–বাবার সাথে গিয়েছিলাম দেখতে, একটা বিদেশি সিনেমা। গল্পে ছিল–ওরকমই কিম্ভুত টাইপের একটা ভিনগ্রহী এসে নামলো। হাত-পা’গুলো সাপের মতো কিলবিল করছে। বাড়ির পোষা সবার প্রিয় কুকুরের ছানাটাকে তুলে নিয়ে নিজেদের জগতে ফিরে গেল। পরে অবশ্য বছর পাঁচেক বাদে কুকুরের ছানাটাকে একদম হুবহু একই অবস্থায় পাওয়া গিয়েছিল, কিন্তু মৃত। বিগত পাঁচ বছরে ছানাটার বয়স একই থেকে গেছে, একটুকুও বাড়েনি।”

 

ওদের কথা শুনতে শুনতে কখন যে একটু তন্দ্রামতো এসে গিয়েছিল বুঝতেই পারিনি। হঠাৎ করেই কেমন যেন মনে হলো একটা সরু নরম দড়ি বা গাছের ডালের মত কিছু আমার কানের পাশের চুলগুলোতে নড়াচড়া করছে। ঘুমটা ভেঙ্গে গেল।  আরে, এটা আবার কি! ধরে টেনে ফেলে দিতে গেলাম, কিন্তু কিছু একটার সাথে যেন আটকে আছে। এতটাই ক্লান্ত ছিলাম যে ঘরের আলোটা জ্বেলে একটু যে দেখবো, জিনিসটা কি সেটাও ইচ্ছে করছিল না। দড়ির মতো গরম জিনিসটাকে হাত দিয়ে ঠেলে সরিয়ে দিয়ে ওপাশ ফিরে শুলাম। নাঃ, আবার। এবার এপাশের চুলে সেই একই অনুভূতি। গেল ঘুমটা  চটকে। বিছানার উপর উঠে বসলাম। লাইটটা জ্বালবো বলে খাট থেকে নামতে  গেছি, দেখি দুপাশ থেকে আমার হাত ধরে কে যেন টানছে। আমি আঁতকে উঠলাম অন্ধকারে। এটা আবার কে রে?

একদম কানের পাশ থেকে উত্তর এলো,” বলো কাউকে বলবে না।”

“বলবো না মানে! তুমি কে? আমাকে খাট থেকে নামতে দিচ্ছ না বা কেন? আলোটা জ্বালাতে দাও তবেই না তোমাকে দেখতে পাবো।  হয়তো চিনতেও পারবো।”

 

“তুমি আমাকে চিনতে পারবে না। শুধু তুমি কেন তোমাদের এই গ্রহের কেউই এর আগে আমার মতো কাউকে দেখোনি।”

“মানে? ইয়ার্কি হচ্ছে? তুমি আমার হাত ছাড়ো বলছি। না হলে এবার কিন্তু চিৎকার করে মা-বাবাকে ডাকবো, তখন বুঝবে। কানটা ধরে আমার মা যখন তোমার গালে দেবেন দুটো, তখন বুঝবে। মজা করা বেরিয়ে যাবে।”

“প্লিজ, ঐ কাজটা দয়া করে কোরোনা, আমি প্রচন্ড রকমের বিপদে পড়ে যাবো। আমি জানি আমার বাবা-মাও আমাকে খুঁজছে হন্যে হয়ে পাগলের মতো। আমিও তো ওদের একমাত্র মেয়ে। গতকাল রাতে আমরা তিনজন এই গ্রহের চারপাশে ঘুরে দেখছিলাম। তোমাদের উপগ্রহটায় তিনদিন থাকার পর দূর থেকে এই গ্রহটাকে দেখে ফিরে যাবো, এরকমই পরিকল্পনা ছিলো। কিন্তু কে জানে এরকম একটা দুর্ঘটনা ঘটে যাবে।”

 

সে আরও বলে, “আমি জানালার বাইরে একটু মাথাটা বের করে ভালোভাবে এই গ্রহটাকে দেখার চেষ্টা করছিলাম। কোমরের সিট বেল্টটা অসুবিধা হচ্ছিল বলে খুলে রেখেছিলাম। হঠাৎ আমাদের মহাকাশ যানটি সামান্য ডানদিকে কাত হয়ে যেতেই আমি জানালা গলে পুরো বাইরে। মুহূর্তের মধ্যে মাধ্যাকর্ষণের টানে এই গ্রহের বায়ুমন্ডলে প্রবেশ করে সোজা পাঁচশ কিলোমিটার প্রতি ঘন্টা বেগে ক্রমাগত নিচের দিকে নেমে এসে গভীর রাতে তোমাদের বাগানের পুকুরধারে নরম ভিজে জমিতে সজোরে আছড়ে পড়লাম। গায়ে বিশেষ পোশাকটা ছিলো বলে প্রাণে বেঁচে গেছি। পোশাকটা নামার সময় পুরোটাই পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। প্রথমে তোমাদের বাগানের পুবধারে কলাবাগানে লুকিয়ে ছিলাম। তোমার মত দেখতে প্রাণীগুলো দু-পায়ে হেঁটে শুধু আসছে আর যাচ্ছে। ওদের সামনে দিয়ে আসতে পারছি না। একটা গাছ হেঁটে যাচ্ছে এই দৃশ্য তো এখানে আগে কেউ কখনো দেখেনি।”

 

চমকে উঠলাম, “কি বলছো যা তা। তুমি একটা গাছ? আর সেই গাছটা মানুষের মতো কথা বলতে পারে,  হাঁটতে পারে, আবার মহাকাশ যানে চেপে এক গ্রহ থেকে আরেক গ্রহে ঘুরে বেড়ায়? পাগল কোথাকার। তুমি আমাকে বুদ্ধু পেয়েছ? যা খুশি বলবে আর আমি হাঁ করে বোকার মত সব শুনে যাবো। আমি ক্লাসে আমাদের সেকশনের ফাস্ট গার্ল। আমি কুংফু-ক্যারাটেও জানি। ঘাড়ের পাশে এমন একটা দেবো না এক্কেবারে দশ হাত দূরে ছিটকে গিয়ে পড়বে।”

“সেটা তুমি কখনোই পারবে না। আর আমার তো ঘাড় বলে কিছুই নেই। আমিতো একটা গাছ। আমাদের কোনো ব্যথা যন্ত্রণাও নেই। নাহলে ভাবতো, সেই কোন উঁচু থেকে অত বেগে এসে নিচে পড়লাম, একফোঁটা ব্যথা পেলাম? কারণ তোমাদের মতো আমাদের শরীরে তো কোনও নার্ভ নেই। মাথাই তো নেই। আমরা গোটা শরীর দিয়েই দেখতে পাই, গোটা শরীর দিয়েই কথা বলি, শুনতে পাই। আমরা আমাদের জোড়া নক্ষত্রের আলোয় নিজেরাই নিজেদের খাদ্য তৈরি করি। আমাদের আকাশে দুটো সূর্য। আমাদের গ্রহ নিজের চারপাশে ছত্রিশ ঘন্টায় একবার প্রদক্ষিণ করে। প্রতিটি সূর্য আঠারো ঘন্টা করে আলো দেয়। আমাদের রাত নেই, আমাদের ঘুমও নেই,আমাদের গ্রহে জল নেই। কয়েক কোটি বছর আগে ছিলো, বাবার কাছে শুনেছি। মাটি আছে তবে শুকনো, প্রায় পাথরের মতো। আমরা শুকনো খাবার তৈরি করি এবং যেহেতু নিজেদের খাবার নিজেরাই তৈরি করি, তাই খাদ্যের জন্যে কারোর উপর নির্ভরশীল ন‌ই। পরস্পরের মধ্যে হানাহানিও  নেই।”

 

যত শুনছি, ততই অবাক হয়ে যাচ্ছি।

বললাম, “তোমাদের স্কুলে যেতে হয়না?”

“স্কুলে গিয়ে কি করবো? পড়াশুনা করে ভালো রেজাল্ট করে তোমরা চাকরি করে উপার্জন করো পেট চালানোর জন্যে। কারণ তোমাদের সবকিছুই কিনে খেতে হয়। আমাদের তো সেই বালাই নেই।  সারাদিন শুধু বিভিন্ন গ্রহে, উপগ্রহে  ঘুরে বেড়াও। আমরা তিনজন প্রায় দেড় বছর আগে, তোমাদের হিসেবে যেটা এক বছর হবে, আমাদের গ্রহ থেকে রওনা দিয়েছিলাম। বাবা বললো, “চলো, দূরে যে নীল-সবুজ গ্রহটা দেখা যাচ্ছে, ওখান থেকে ঘুরে আসি। মনে হচ্ছে আমাদের মতো সবুজ প্রাণী ওখানেও আছে। তবে নীল রং দেখে মনে হচ্ছে ওখানে জল আছে। তার মানে অন্য প্রজাতির জীবও আছে। তাই গ্রহের বুকে নামাটা বুদ্ধিমানের কাজ হবে না। চারপাশে দিন তিনেক ঘুরে আবার ফিরে যাবো।”

 

“আমাদের ওখানে বড়দের এটাই কাজ। আশেপাশের গ্রহ ঘুরে বেড়িয়ে খবর সংগ্রহ করা এবং বৃক্ষ অফিসের প্রধানের কাছে সেগুলো জমা দেওয়া। পরবর্তীতে সেগুলো পর্যালোচনা করে আশেপাশের জগত সম্বন্ধে একটা সিদ্ধান্তে আসা।”

কি আশ্চর্য জগৎ তোমাদের! তোমরা ছাড়া ওখানে আর কোন প্রজাতির প্রাণী নেই?“

 

“আছে, ভাইরাস।  প্রতিবছর অনেকেই মারা যায় এদের সংক্রমনে।”

“অন্যান্য আর কোনো প্রাণী বা ব্যাকটেরিয়া?”

“না, জল ছাড়া অন্য প্রাণীরা কেউ বাঁচে না। মনে হচ্ছে  আমার মা কাছাকাছি আমাকে খুঁজতে খুঁজতে চলে এসেছে। আমি আমার মা’র শরীরের গন্ধ পাচ্ছি।”

“কি করে বুঝতে পারছো?  শরীরের আবার গন্ধ হয় নাকি?”

“হয়, আমাদের প্রত্যেকের নিজস্ব আলাদা গন্ধ আছে। আমরা সবাই দেখতে একই রকম, তাই গন্ধ শুঁকেই আমরা নিজেদেরকে চিনতে পারি।”

“তোমার নাম কি?”

“আমাদের নাম হয় না। সংখ্যা। আমার দুই লক্ষ পাঁচ হাজার বত্রিশ বাই দুই। আমার বাবা-মা’র মিলিতভাবে দুই লক্ষ পাঁচ হাজার বত্রিশ। তোমাদের এখানকার মতো আমাদের আকাশ নীল নয়, ধুসর। জল নেই কিনা।”

 

জানালার বাইরে অন্ধকারে একটা ছোটো গাছের মতো কি যেন এসে দাঁড়ালো। স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে। আমার দুটো হাত এতক্ষণ যে ধরেছিল, এবার সে তার ডালপালা দিয়ে আমায় জড়িয়ে ধরলো। আমি তার হৃদপিন্ডের ওঠানামা টের পাচ্ছিলাম। একটা খসখসে আওয়াজ হলো। বুঝলাম, আমার ভিনগ্রহী বন্ধু আমায় ছেড়ে চলে যাচ্ছে।

 

সেই রাতটা আমি ঘুমোতে পারিনি। সারারাত কেঁদেছিলাম। আমি কখনও তার কথা ভুল করেও কাউকে বলিনি। আমি তাকে কথা দিয়েছিলাম। আজ প্রথম তোমাদের কাছে আমি আমার সেই ভিনগ্রহী বন্ধুর কথা জানালাম। যদিও আমি তার কাছে কথা দিয়েছিলাম যে, কোনদিনও তার কথা কাউকে জানাবো না।  কারণ আমি জানি যে তোমরা কেউ আমার কথা বিশ্বাস করবে না। যদি একটা সেদিনের ছবি বুদ্ধি করে তুলে রাখতে পারতাম আমার মোবাইলে, তাহলে বিশ্বাস করানোটা অনেক সহজ হতো।

 

আর সত্যি কথা বলতে কি আমি তো নিজেই তাকে চোখের দেখা দেখিনি। তার গায়ের রং বা সে আদপেই হুবহু আমাদের পৃথিবীর গাছেদের মতো কিনা বা গাছ হলেও ঠিক কোন গাছের মতো? আম, জাম বা টগর নাকি গোলাপের মতো। তার শরীরে ডালপালা ছিল, এই ব্যাপারে আমি নিশ্চিত কিন্তু পাতা ছিল কিনা সেটার ব্যাপারেও নিশ্চিত ন‌ই। সে তো দেখার সুযোগ‌ই  দিলো না। কিছুতেই ঘরের আলো জ্বালাতে দিলো না। কিন্তু কেন দিলো না?  সে কি ভেবেছিল যে আমি তাকে দেখে ভয় পেয়ে যাবো? কি জানি হয়তো হতেও পারে। একটা গাছ মানুষের মতো কথা বলছে, চলে ফিরে বেড়াচ্ছে–এটা তো নিঃসন্দেহেই একটা অবাক করা ঘটনা, যেটা একমাত্র ভাবনাতেই আসা সম্ভব, বাস্তবে নয়। কিন্তু আমি নিজের কান বা অনুভূতিকে অস্বীকার করি কিভাবে? জানালার বাইরে অন্ধকারে তার মায়ের খড়খড়ে শব্দের উপস্থিতি এবং আমাকে জড়িয়ে ধরে তার শেষ বিদায়ের মুহূর্ত যে এখনো আমার প্রতিটি রোম-অনুরোমে শিহরণ তোলে। এই সত্যটাকে আমি অস্বীকার করি কী ভাবে? কি অদ্ভুত তাদের পৃথিবীর নিয়ম। সেখানে সে শুধুই একটা নাম গোত্রহীন সংখ্যা মাত্র।


পাঠকদের মন্তব্য

কোন মন্তব্য পাওয়া যায়নি

আপনি কি এই লেখায় আপনার মন্তব্য দিতে চান? তাহলে নিচে প্রদেয় ফর্মটিতে আপনার নাম, ই-মেইল ও আপনার মন্তব্য লিখে আমাদের পাঠিয়ে দিন।
নাম
ই-মেইল
মন্তব্য

250

    keyboard_arrow_up