মোহন বাঁশি
ছন্দা চট্টোপাধ্যায়
বিস্তীর্ণ জঙ্গলের ফাঁকে ফাঁকে ছবির মতো ছোটো ছোটো গ্রাম। অনন্য প্রকৃতির সাজানো সংসারে সবুজগাঁও তার অন্যতম। পাশ দিয়ে ছোট্ট চঞ্চল একটা নদী সারাক্ষণ খিলখিলিয়ে হাসতে হাসতে ছুটে চলেছে। মূলত আদিবাসী গ্রাম হলেও বেশকিছু বাঙালি পরিবারের দীর্ঘদিনের বসবাস। নদীর ধার ঘেঁষে মধু হালদারের বিশাল বাগানঘেরা একতলা পাকা বাড়ি। বাড়ির বাসিন্দা একটি আদিবাসী পরিবার–মালিক মধু হালদার আর তার ছেলে মোহন হালদার। সবাই বলে টুবলুর মোহনদাদা আসলে মধু হালদারের দত্তক ছেলে।
একথা শুনে টুবলু মাকে জিজ্ঞেস করেছিল, দত্তক ছেলে কি মা?
ছেলের প্রশ্নে বেশ অবাক হন সুরমা।
মায়ের চোখে অবাক প্রশ্ন দেখে টুবলু বলল, ওই যে আমাদের ক্লাসের তোতন বলছিল মোহনদাদা মধু জেঠুর নিজের ছেলে নয়, দত্তক ছেলে।
মা বলল, ঠিকই বলেছে।
কেন? মোহনদাদার বাবা-মা কোথায়?
সুরমা বলল,পরে বলবো সোনা। এখন আমার অনেক কাজ।
টুবলুর আর তর সইছিল না। দাদুকে পাকড়াও করল।
দাদু বললেন, যেসব বাচ্চার বাবা-মা থাকে না, মানে, যারা অনাথ, অন্য কেউ তাকে নিজের বাচ্চার মতো মানুষ করলে, তাকে দত্তক বাচ্চা বলে। তোমার মধুজেঠু একদিন নদীতে মাছ ধরতে গেছিল। হঠাৎ কচিবাচ্চার কান্নার শব্দ শুনতে পায়। এদিক-সেদিক খুঁজতে খুঁজতে তার চোখে পড়ে বুড়ো বটগাছের ঝুরিতে আটকে আছে পলিথিনে ঢাকা পোটলা-বাঁধা একটা ছোট্ট বাচ্চা । মধু সঙ্গে সঙ্গে তাকে বুকে তুলে নিয়ে দৌড় লাগাল বাড়ির দিকে। তখন ওদের নদীর ধারের বাড়িটা ছিল না।
বাচ্চাটা বেঁচে গেল। কিন্তু বাড়ির লোকেরা বাচ্চাটাকে রাখতে চাইল না। পুলিশের কাছে জমা দিয়ে আসতে বলল। মধু কিছুদিন পুলিশে শখের চাকরি করেছিল বলে থানা -পুলিশের ব্যাপারে সবকিছুই জানত । সেইকারণে মধু বাড়ির লোকদের কথায় রাজি হলো না। নদীর ধারে নিজের আলাদা বাড়ি করে বাবার বাড়ি ছেড়ে চলে গেল।
টুবলুর মনখারাপ হলো এটা ভেবে, একটা বাচ্চাকে কেন ফেলে দিল নদীতে ? আবার আনন্দ হলো এটা ভেবে, মধুজেঠু অন্যের বাচ্চাকে কত ভালোবেসে বড় করেছেন। ভাগ্যিস মধুজেঠুর চোখে পড়েছিল মোহনদাদা! সে তো কল্পনাও করতে পারে না, তার বাবা-মা নেই, এমনকী মোহনদাদাও নেই।
মোহনদাদা যখন হোস্টেলে থেকে কলকাতার কলেজে পড়তে গেছিল, টুবলু তখন বেশ ছোট। কিন্তু মোহনদাদা ছুটিছাটায় বাড়ি এলে খুব আনন্দ হতো। ঘরের দরজার বাইরে থেকে বাঁশির সুর কানে এলেই দৌড় লাগাত টুবলু। আর এখন তো মোহনদাদা গ্রামেই থাকে। তবুও মাঝে মাঝে যখন উধাও হয়ে যায়, তখন খুব মন খারাপ হয় টুবলুর। আসলে বাঁশিই মোহনের সবচেয়ে প্ৰিয় সঙ্গী। মধু হালদার মেডিসিন তৈরিতে কাজে লাগে সেসব গাছ-লতাপাতার চাষ করে। মোহনকে সেইজন্য বটানি নিয়ে কলেজে পড়তে পাঠিয়েছিলেন। মধুর তাড়নায় মোহন বিএসসি ডিগ্রিটা নিয়ে এসেছে ঠিকই। কিন্তু চাষবাসে তেমন আগ্রহ নেই। তবে, কলকাতায় পড়তে গিয়ে তালিম নিয়ে বাঁশিটা আরও ভালো বাজাতে শিখেছে।
জঙ্গলে ঘুরে বেড়ানোই মোহনদাদার নেশা। তবে মোহন শুধু টুবলুর প্ৰিয় মানুষ তা নয়, এই গ্রামের আবাল-বৃদ্ধ-বনিতা সবার প্ৰিয়। তার কারণ, ওর মিষ্টি স্বভাব, অন্যের বিপদে ঝাঁপিয়ে পড়া আর ওর বাঁশির সুর। গ্রামের সবাই বলাবলি করে মোহনবাঁশি! মোহনের বাঁশিতে জাদু আছে। বহুবার জঙ্গলে মোহনদাদার সঙ্গে ঘুরে বেরিয়েছে টুবলু। এই জঙ্গলে হিংস্র জন্তু- জানোয়ার নেই। মোহনদাদার সঙ্গে জঙ্গলের পথে হাঁটতে হাঁটতে টুবলু দেখেছে পাতার আড়ালে, গাছের কোটরে লুকিয়ে থাকা পাখিরা নির্ভয়ে বেরিয়ে আসে বাঁশি শুনে। টুবলুর মনে হয়, কথা না বলতে পারলেও জঙ্গলের গাছপালা,পশুপাখি–সবাই মোহনদাদাকে খুব ভালোবাসে।
শুধু জঙ্গল নয়, মোহনদাদা যেখানে থাকে, সবাই খুব নিশ্চিন্ত বোধ করে। কদিন আগেই তো ঘটনাটা ঘটলো টুবলুর চোখের সামনে। বিকেলে খেলার মাঠে দুই দলে ফুটবল খেলা হচ্ছিল। ল্যাং মারা নিয়ে দুই দলে তুমুল মারপিট শুরু হয়ে গেল। বড়রাও ছাড়াতে পারছিল না। হঠাৎ কানে এল বাঁশির সুর। মোহনদাদা কখন এসে দুচোখ বন্ধ করে একমনে বাঁশি বাজাচ্ছে। দুই দল মারপিট ছেড়ে দিয়ে মোহনদাদাকে ঘিরে ধরলো।
সুরের কি আশ্চর্য মহিমা ! থেমে গেল মারপিট।
যে বাড়ি শিশুবয়সে তাকে আশ্রয় দিতে চায়নি, একদিন সেই বাড়ি থেকে ডাক এল মোহনদাদার। মধু হালদারের বাবার ক্যান্সার হয়েছে। কলকাতায় যতটুকু সম্ভব চিকিৎসা করানো হয়েছে। এরপরে ডাক্তাররা বলে দিয়েছেন, বাড়িতে পেশেন্টকে আনন্দে রাখতে হবে। মিউজিক-থেরাপি করাতে পারলে আরও ভালো হয় । দাদুকে মিউজিক শোনানোর জন্য নানারকম ব্যবস্থা করা হলো। কিন্তু তিনি জেদ ধরে বসে আছেন, মোহনের বাঁশি শুনবেন। মোহনের জেঠু কানু হালদার, তার ছেলে, জেঠিমা সবাই বেঁকে বসলো। তারা কিছুতেই মোহনকে এ বাড়িতে ঢুকতে দেবে না। মধু মাঝে মাঝে বাবাকে দেখতে আসে, ঠিক আছে। কিন্তু মোহন নয়।
অবশেষে হাল ধরলেন মধুর মা। কাউকে কিছু না জানিয়ে তিনি সোজা চলে গেলেন মধুর বাড়ি। মোহন আর মধুকে ধরে নিয়ে এলেন। দাদুর বিছানার পাশে মোহনকে বসিয়ে বললেন, এখন থেকে দাদুর দায়িত্ব তোমার। তোমার বাঁশি শোনার জন্য আকুল হয়ে আছে দাদু । যে অন্যায় আমরা তোমার সঙ্গে করেছি, তার জন্য ক্ষমা চাওয়ার মুখ আমাদের নেই। ঠাকুমা আঁচলে চোখ মুছলেন। মোহন কোনও কথা না বলে, দুচোখ বন্ধ করে বাঁশি বাজানো শুরু করলো। মধুরও মনে হলো এমন সুর সে আগে কোনোওদিন শোনেনি। দাদুর দুচোখ বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে আনন্দ-অশ্রু। সুরের মায়ায় আলোকিত হয়ে উঠল ঘরের প্রতিটি কোণ । সেই আলোর রেশ ছড়িয়ে পড়ল দূরে-দূরান্তরে ।
পাঠকদের মন্তব্য
250