অক্সিজেন
সর্বাণী বন্দোপাধ্যায়
মাঠের দিকে চোখ চলে যাচ্ছিল রুবীনের৷ শঙ্খরা সব মাঠে নেমেছে৷ ও একা, টেবিলের ওপর অঙ্কের খাতা বিছিয়ে বসে আছে। কিছু করুক না করুক, এভাবেই বসে থাকতে হবে ওকে। ওর মা ওকে বিকেলে অঙ্ক করার শাস্তি দিয়েছেন৷ ওর খেলা বন্ধ৷
রুবীনের মা স্কুলে পড়ান৷ খুব কড়া। এবারে উইকলি টেস্টে রুবীনের মার্কশিট দেখে উনি ‘থ’৷ বাংলা, ইংরেজি, ইতিহাস সবেতে মোটামুটি ভালো নম্বর, কিন্তু অঙ্কে পাস মার্কস নেই! চোখ গোল গোল করে মা বলেছিলেন, ‘‘ব্যাপার কি? অঙ্কে তেরো! এর থেকে ভালো হতো যদি তুমি অঙ্কে শূন্য পেতে!’’
“কেন?” না বুঝে প্রশ্নটা করেছিল রুবীন৷
“বুঝলে না, বলতে কত সুবিধে হত, বলতে জিরো আউট অফ ফিফটি।”
রুবীন মাথা হেঁট করে বসেছিল তখন৷ বাবা ট্যুরে গেছেন, ঠামি তো সারাক্ষণই ঠাকুরঘরে৷ মা দোকানে কেনাকাটা করতে বেরোলে রুবীন দাদুর ঘরে ঢুকেছিল সব কথা খুলে বলার জন্য। ওর মনে কি দুঃখ হতে নেই?
দাদু কাগজ থেকে চোখ তুলে বলেছিলেন, “কে দাদুভাই? শুনলাম তুমি নাকি এক কীর্তি করেছো?”
“মানে?”
“আরে বাপু, কীর্তির মানে জানো না? বাংলা তোমাদের পড়ানো হয় তো? কীর্তি মানে খুব সম্মানীয় কোন কাজের দৃষ্টান্ত স্থাপন করা৷ যেমন বুদ্ধদেব বৌদ্ধধর্মের প্রচলন করে বিশেষ কীর্তি স্থাপন করেছিলেন৷ আলেকজান্ডার দিগ্বিজয় করে কীর্তি স্থাপন করেন৷ তাজমহল নির্মাণ করেন শাহজাহান৷ সেটা তাঁর বিশেষ কীর্তি৷ আরো বলব?”
রুবীন বলে, “আর উদাহরণ দিতে হবে না৷ আমি অঙ্কে তেরো পেয়ে কীর্তি স্থাপন করেছি৷ এটাই বলতে চাইছো তো?”
“চাইছি না চাইতে হচ্ছে৷ তোমার মা এইমাত্র আমাকে বলে গিয়েছেন, আপনি কলেজে অঙ্ক করাতেন, আমি স্কুলে বিজ্ঞান পড়াই, আর আপনার ছেলে বরাবর অঙ্কে হায়েস্ট পেয়েছে বলে শুনেছি৷ কিন্তু আমার ছেলে ক্লাসের সাপ্তাহিক পরীক্ষায় অঙ্কে তেরো পেল! আপনি কিছু বলবেন না জানি, কিন্তু আমি কিছু বললে বাধা দেবেন না।”
আজ রবিবার৷ মা ভীষণ রেগে চুপচাপ হয়ে আছেন বলে রুবীন হাত থেকে পড়ার বই ছাড়েনি৷ কিন্তু শেষরক্ষা হল না। মা দুপুরের খাওয়ার পরেই ঘোষনা করলেন,
“বিকেলে এবারের সিলেবাসের দশটা অঙ্ক কষে, আমায় সন্ধেবেলায় দেখাবে৷ আজ থেকে দশদিন তোমার এই রুটিন চলবে৷”
রুবীন একবার নরম গলায় বলার চেষ্টা করেছিল, “কিন্তু বিকেলে তো আমি মাঠে খেলতে যাই৷”
মা ঠাণ্ডাভাবে বলেছিলেন “জানি রুবীন, তবে আমাদের মতো বাড়ির ছেলের অঙ্কে ফেল করাটা মানতে পারছি না। তাই…! আর কিছু বলবে তুমি?”
ও চলে এসেছিল৷ মা যখন ‘তুমি’ সম্বোধন করেন, তখন বিপদ ঘাড়ে চেপেছে যে, সেটা সহজেই বোঝা যায়৷
করোনার হঠাৎ বাড়াবাড়িতে স্কুল বন্ধ হয়েছে৷ কিন্তু বিকেলে সামনের পার্কের মাঠে রুবীনদের দলের খেলা বন্ধ হয়নি। জানলা দিয়ে ওইদিকে তাকিয়ে রুবীন বসে আছে। খোলা খাতা যেমনকে তেমন খোলাই রয়েছে৷ দাদু এসে রুবীনের পাশেই বসলেন৷ রুবীন তাকাতেই দাদু ঠোঁটে আঙুল দিয়ে ওকে চুপ করতে বললেন৷ তারপর বললেন, “প্রহারেন ধনঞ্জয়” কথাটার মানে জানো?
রুবীন আবার মাথা দুদিকে নাড়ে৷ দাদু নিজের গালে চড় মারার ইঙ্গিত করে বলেন, “খেলা তো হলো না, মার কিন্তু বন্ধ থাকবে না৷ ধনঞ্জয় মানে অর্জুন৷ অর্জুন যেমন যুদ্ধে প্রহার করতেন, মানে মারতেন, সেরকম প্রহার পাবে৷ একটা অঙ্ক তো করোনি দেখছি৷ শিগগিরই করে ফেলো। তোমার মা এই এলেন বলে৷ আমার হেল্প করা বারণ৷ আমি বেরোচ্ছি৷ তোমার ‘মার’ খাওয়া হয়ে গেলে ফিরব৷ বসে বসে মার খাওয়া দেখতে পারব না বাবু৷”
দাদু চলে যাবার পরে রুবীন অঙ্কর খাতা টেনে বসে আর সোজা দেখে ঝপাঝপ দশটা অঙ্ক করে ফেলে৷
এই নিয়ে তিনদিন হলো৷ রুবীন স্কুল বাস থেকে নামার পর মা ওকে নিতে যাচ্ছেন৷ বিষয়টা সবাই বুঝতে পারছে৷ স্কুলের অন্য বন্ধুরা মাকে চেনে, ওকে উনি কেন স্কুল বাস থেকে নিতে আসছেন, সেটাও জানে৷ কারণ একটাই, ও যাতে বাস থেকে নেমে খেলতে না পারে৷ বাস থেকে নামার পর ওরা বাড়ির কম্পাউন্ডে কিছুক্ষণ বল পিটিয়ে নেয়, তারপর ফ্ল্যাটবাড়ির বিভিন্ন ব্যালকনি থেকে মায়েদের সম্মিলিত ডাক কানে এলে, সবাই ঘরে ফেরে৷
এখন আর সেটা সম্ভব হচ্ছে না৷ রুবীনের খুব মন খারাপ৷ ও যে অঙ্ক জানে না, তা তো নয়৷ একটুর জন্য ও অঙ্কগুলো ভুল করেছে৷ আগামিকাল অপরাজিতা আবাসনের সঙ্গে ওদের নীলকমল আবাসনের ফুটবল ম্যাচ। বন্ধুরা আজও স্কুলে বলেছে, তুই না খেললে আমরা গো হারান হারব৷ কি করবে ও? উপায় তো নেই৷
সাতদিন হলো৷ আজ রবিবার৷ সকালে হঠাৎ এমন একটা ঘটনা ঘটল, যার জন্য কোনও প্রস্তুতি ছিল না৷ কোন্নগরের মাসিমনি বাথরুমে পা পিছলে পড়ে গেলেন। ওনার ছেলে-মেয়ে দুজনেই থাকে বিদেশে৷ ভালো একজন কাজের লোক আছে৷ সে খবর দিতেই মা ছুটলেন মাসিমনির পায়ের ব্যবস্থা করতে।
যাবার আগে রুবীনকে বলে গেলেন, “তুমি কিন্তু বিকেলে খেলতে বেরিও না। আমি না থাকলেও এসে সব খবর পাব। কোশ্চেন বানিয়ে দিয়ে গেলাম৷ সব অঙ্ক করে রাখবে।”
মায়ের দিকে তাকায় না ও৷ চোখ ফেটে জল আসছে৷ বিকেলের এই ম্যাচটার জন্য কবে থেকে অপেক্ষা করছে৷ এভাবে সেই সুযোগ নষ্ট হলে খুবই খারাপ লাগে৷ মা চলে যাবার পর, দাদুর সঙ্গে ওর দেখা হলো খাবার টেবিলে। দাদুর গম্ভীর মুখ দেখেই ও বুঝল, মায়ের সঙ্গে ওকে আটকে রাখার ব্যাপারে নিশ্চয়ই কিছু রাগারাগি হয়েছে। তাই দাদুর মুখভার হয়ে আছে৷
সারা দুপুর বসে বসে মায়ের প্রশ্নমাফিক সব অঙ্ক করে রাখল৷ আসলে ও অঙ্কে তো খারাপ না, মনোযোগ না দেওয়ার জন্যই নম্বর খারাপ হয়েছিল। দুপুরে সবগুলো অঙ্ক করার পর ক্লান্ত হয়ে একটু ঘুমিয়ে পড়েছিল ও৷ ঘুমটা ভেঙে গেল কারও ডাকাডাকিতে৷ ঘরের মধ্যে দাঁড়িয়ে আছেন দাদু, “কিরে তুই ঘুমোচ্ছিস, ওদিকে তোর দল তো গো হারান হারছে৷ ভালো খেলত শঙ্খ, ওর তো পায়ে লেগেছে, তাই বসে আছে৷ প্রদীপ একা আর কি করবে? আবাসনের সবাই তোর কথা বলছে৷ বলছে, রুবীন থাকলে এভাবে হারতে হতো না৷”
রুবীন ঘুমভাঙা চোখে একবার দাদুর দিকে তাকায়৷ তারপর দৌড়ে গিয়ে মুখেচোখে জল দিয়ে ওদের আবাসনের খেলার জার্সিটা পরে বেরিয়ে যায়৷ দাদু দু-একবার, “ওরে রুবীন,” বলে পিছন থেকে ডাক দেন। তারপর মিটিমিটি হেসে রুবীনের পেছন পেছন এগোতে থাকেন৷ আবাসনে ঢোকার মুখেই বেশ কয়েকজন মহিলা রুবীনের মাকে দেখে এগিয়ে এলেন৷
“কি গো, এতক্ষণে ফিরলে? তোমার ছেলের জন্য নীলকমল আবাসনের মানরক্ষা হলো৷ কী খেলাটাই না খেলল ও৷ হা করে দেখছো কী, বাড়তি খেলোয়াড় হিসেবে খেলতে নেমে তিন গোল দিয়েছে রুবীন। তাই একগোলে জিতেছি আমরা৷ যাও যাও ঘরে যাও৷ ছেলেকে মিষ্টি খাওয়াও৷”
থমথমে মুখে ঘরে ঢুকেই মা রুবীনের কাছে জানতে চান, পুরো পেপারটা ও কষেছে কিনা৷ তারপর খাতা হাতে নিয়ে দ্রুত তাতে চোখ বোলান৷ চশমার মধ্যে দিয়ে শক্ত চোখে তাকিয়ে বলেন, “তোমাকে না বলেছিলাম খেলতে যাবে না৷”
রুবীন মাথা নিচু করে বলে, “সেজন্য যা শাস্তি দেবে দাও৷ আমি আগে খেলতে যাইনি৷ কিন্তু অপরাজিতা আবাসনের কাছে নীলকমল আবাসনের হেরে যাওয়াটা আমি মানতে পারিনি৷ তাতে আমার নীলকমলের জার্সির অপমান হতো৷”
রুবীনের মা ওর দিকে হাঁ করে তাকিয়ে কী বলবেন ভাবছিলেন৷ দাদু ঘরে ঢুকে বলেন,“রুবীন নীলকমলের জার্সির মান রেখেছে৷ ওকে বকো না৷ খেলাধুলো না করে ও দিনদিন শুকিয়ে যাচ্ছিল৷ আগে শরীর তারপর তো মাথা৷ অঙ্ক সব ভুল করেছে কী?”
ওর মা ধীরে ধীরে বললেন,“না সব ঠিক করেছে৷”
দাদু হাসেন, “আজ ও শাস্তি পাবার ভয় সত্ত্বেও আবাসনের কথা ভেবে খেলতে গিয়েছে৷ এই স্পিরিটটাই দরকার। তবেই তো কাল নিজের কথা না ভেবে দেশের কথা ভাববে৷ তবে যাই করুক, ওর খেলা বন্ধ করো না৷ ওটাই ওর নিঃশ্বাসবায়ু৷ ওটা না পেলে বাঁচবে কি করে?”
মা বলেন, “বুঝেছি, এবার আপনারা খেতে আসুন৷ আপনার নিঃশ্বাসবায়ু যে আপনার নাতি তাও আমি জানি৷”
এবার দাদু চোখেচোখে ইশারা করতেই রুবীন বলে, “স্যরি মা৷”
পাঠকদের মন্তব্য
250