অক্টোপাসের হাসি
তনুজা চক্রবর্তী
বাবা-মায়ের সঙ্গে বকখালিতে বেড়াতে এসে বেশ অবাক হয়েছে দিয়া। এখানকার সমুদ্রটা ঠিক দীঘা-পুরীর মতো অত রাগী নয়। যদিও দীঘার থেকেও পুরীর সমুদ্রটা অনেক অনেক বেশি রাগী। দীঘা যদি তাদের স্কুলের ইতিহাসের ম্যামের মতো রাগী হয়, পুরী তাহলে প্রিন্সিপাল ম্যাডাম। কথাগুলো ভেবে খুব হাসি পেল তার।
এই সমুদ্রটা যেন শান্তশিষ্ট একটা ছেলে, যে সারাদিন তট ছোঁয়ার খেলায় মেতে আছে। ছোট্ট ছোট্ট ঢেউদের লাইন বরাবর পাশাপাশি দাঁড় করিয়ে ঠেলে দিচ্ছে তীরের দিকে। কিছুটা আসার পর আবার তারা ফিরে যাচ্ছে। ওদের দেখে দিয়ার স্কুলের জল থেকে লেবু তোলা দৌড়ের কথা মনে পড়ছে। এখানে অবশ্য ঢেউগুলোকে লেবু মুখে নিয়ে দৌড়তে হচ্ছে না। তারা পর্যটকের পা ছুঁয়ে চলে যাচ্ছে। এমন পা-ছোঁয়ার প্রতিযোগিতার দর্শক হতে পেরে খুব আনন্দ হচ্ছে তার। দিয়ার পা’ও ছুঁয়ে গেছে বেশ কয়েকবার।
বাড়ি থেকে গাড়ি করে বেরিয়ে দিয়াদের সেখানে পৌঁছতে পৌঁছতে প্রায় একটা বেজে গেছে। হোটেলে ঢুকে একটু ফ্রেশ হয়ে লাঞ্চ সেরে তারা বেরিয়ে পড়েছিল সমুদ্র দেখতে। আকাশটা মেঘে ছেয়ে আছে, রোদের দেখা নেই। তাই মেঘলা আকাশ মাথায় নিয়ে তীরে ঘুরে বেড়াতে তেমন কষ্ট হবে না বলে দুপুর বেলাতেই হোটেল ছেড়ে বেরিয়ে পড়েছিল তারা।
সমুদ্রটাকে দেখে বেশ বুদ্ধিমান বলে মনে হলো দিয়ার। ভাটার টানে তীর থেকে অনেক দূরে চলে যাওয়ার আগে বেশ কয়েকটা ছোট্ট ছোট্ট পুকুর তৈরি করে গেছে। যদিও ছবি দেখে এগুলোর নাম আগেই জেনেছে দিয়া। এগুলোকে বিদেশে লেগুন বলা হয়। সাঁতার না জেনেও দিয়া দিব্যি পুকুরগুলো এপার ওপার করতে পারছিল। তার মতো ছোটো ছোটো অনেক ছেলেমেয়েই সেটা করছিল। অথচ তাদের বাড়ির পুকুরে আজ পর্যন্ত নামার সাহস হয়নি দিয়ার
বেশ কিছুক্ষণ এপুকুর, ওপুকুর পারাপার করার পর দূরের সমুদ্র অবধি পৌঁছানোর পথে ঝাঁকে ঝাঁকে লাল কাঁকড়াদের ভয় পেতে দেখে খুব কষ্ট হচ্ছিল তার। কী সুন্দর সাদা সাদা চোখ মেলে ফুলের মতো ফুটে উঠছে তারা। আর যেই পায়ের শব্দ পাচ্ছে অমনি গর্তের মধ্যে ঢুকে পড়ছে। অনেকক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকার পরেও ওদের কেউ একটা সুন্দর ছবি তোলার জন্য পোজ দিল না দেখেও দিয়ার একটুও রাগ হয়নি। বরং তার মনে হয়েছে ওরা বেশ অহংকারী। যাকে তাকে নিজেদের ছবি শেয়ার করার কোনো ইচ্ছে ওদের নেই।
দিয়া নিজেও চায় না, কেউ ওদের ছবি তুলুক। তারপরেও মাঝে মধ্যে বাধ্য হয়েই তুলতে হয়। যেমন একটু আগেই দূর থেকেই তার বাবা তাদের ছবি তুলল, তার আগে মা’ও তুলেছে। এখন সেগুলো মোবাইলে যে যার বন্ধুমহলে পোস্ট করবে। বাবা বলেছে, ভোটের সময় বেশি পর্যটকদের আনাগোনা নেই বলেই কাঁকড়াদের দেখা যাচ্ছে। ভাগ্যিস এমন সময় এসেছিল তারা, নাহলে তো লাল কাঁকড়া দেখাই হতো না তাদের।
এসব কথা ভাবতে ভাবতে সে পৌঁছে গেছে আরও একটা পুকুরের কাছে। সেটা টপকানোর পর তারা পৌঁছতে পারবে সমুদ্রের কাছে। পুকুরটা টপকাতে গিয়ে হঠাৎই সে টের পেল তার জলে ডোবা পায়ের আঙুলে কারা যেন কুটকুট করে কামড়ে দিচ্ছে। পায়ের দিকে তাকাতেই দেখল একঝাঁক অতি ক্ষুদ্র মাছের দল পিলপিল করে সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে।
বেশ করেছে ওরা। না কামড়ালে তো কাঁকড়াদের নিয়ে তার ভাবনার জগত থেকে বেরিয়ে ওদের দিকে চোখ পড়ত না। এই এক বদ অভ্যাস রিয়ার, কিছু নিয়ে একবার ভাবতে শুরু করলেই হলো, কোথায় থামতে হবে ভুলে যায়। ওমা! ওই তো আর এক ঝাঁক এগিয়ে আসছে তার দিকে। দিয়া ওদের পিছু নিয়ে বেশ খানিকটা এগিয়ে গেল। বাবার ডাকে পিছু ফিরতেই হারিয়ে গেল তারা। ওদেরও বোধহয় কেউ ডাকছিল, সামনেই ওদের ঘর,সেখানেই ঢুকে পড়েছে।
এরপর দিয়ারা পৌঁছে গেল সমুদ্রের কাছে। জলে পা ডুবিয়ে সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে ঢেউগুলোর পা ছোঁয়া খেলার সঙ্গী হয়ে গেল। ঢেউয়ের সঙ্গে খেলতে খেলতে হঠাৎই সে দেখল তার থেকে কিছুটা দূরে কয়েকজন বেশ খানিকটা ঝুঁকে কিছু একটা দেখে বেশ উত্তেজিত হয়ে কথা বলছে। তাদের মধ্যে একজন আবার তীরে দাঁড়িয়ে থাকা একজনকে ইশারায় ডাকল। ডাক শুনে তীরে দাঁড়ানো মানুষটি আসার পর তার হাতে থাকা প্লাস্টিকটা নিয়ে বালি থেকে কিছু একটা তুলে ভরে দিল তার মধ্যে।
সেটা দেখার পর দিয়া ছুটল তাদের দিকে। তাদের কাছে পৌঁছে জানতে চাইল, কী রাখল তারা প্লাস্টিকের মধ্যে? একজন বলল অক্টোপাসের বাচ্চা। দিয়া দেখতে চাইলে, তাকে দেখাতেই সেই বাচ্চা অক্টোপাসের করুণ চোখদুটোর দিকে চোখ পড়ে গেল দিয়ার। বাচ্চাটি যেন বলে উঠল, আমাকে বাঁচাও। দিয়া নিজেকে আর ধরে রাখতে পারল না। মুহূর্তের মধ্যে তাদের হাত থেকে প্লাস্টিকটা কেড়ে নিয়ে ছুটতে লাগল সমুদ্রের দিকে।
কয়েক সেকেন্ড হতবাক হয়ে দাঁড়িয়ে থাকার পর লোকগুলিও ছুটল তার পেছন পেছন। দিয়া ততক্ষণে সমুদ্রে বেশ খানিকটা নেমে গেছে। দিয়ার বাবাও দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য অবস্থাতে হাতের ক্যামেরাটা বালিতে ফেলে ছুট লাগিয়েছে। হাজারবার বলার পরেও এতক্ষণ যাকে সমুদ্রে স্নান করতে নামানো যায়নি, তাকে একা একা সব ভয় ভেঙে সমুদ্রে নামতে দেখে, বেশ অবাক লাগল দিয়ার মায়ের।
দিয়া ততক্ষণে অক্টোপাসের বাচ্চাটাকে জলে ভাসিয়ে তার দিকে তাকিয়ে আছে। সে বেমালুম ভুলে গেছে সমুদ্রে নেমে যাওয়ার কথা। সে শুধু দেখছে অক্টোপাসের হাসি, যা কোনোদিন কেউ দেখেনি। হাসতে হাসতে একসময় সেটা হারিয়ে গেল সমুদ্রের বুকে।
দিয়ার বাবা জড়িয়ে ধরেছে মেয়েকে। দিয়ার কোনো হেলদোল নেই–সে তখনও তাকিয়ে আছে অক্টোপাসের হারানো পথের দিকে।
আরেকটু সামনের দিকে এগোলেই সাংঘাতিক একটা কান্ড ঘটে যেতে পারত।
যারা সেই অক্টোপাসের বাচ্চাটাকে ধরেছিল, তাদের মুখেও কোনো কথা নেই। হয়তো তারাও তখন ভাবছে, জোর বাঁচা বেঁচে গেল মেয়েটা !!
পাঠকদের মন্তব্য
250