খুশির কাণ্ড
পিয়ালী ভট্টাচার্য
খুশি একটা চোখ বুজে কাঁদতে কাঁদতে মা'য়ের কাছে এসে বলতেই মা'র তো চোখ ছানা বড়া ! মুখের জিনিস কীভাবে চোখে আটকে যায় ! ভয় পেয়ে খুশি তারস্বরে কাঁদছে। ক্লাস টুয়ের খুশি এর আগে দুষ্টুমি করে বাথরুমের দরজা বাইরে থেকে আটকে দিয়েছে, জিনিসপত্র লুকিয়ে অন্যকে নাকাল করেছে, পাউডার মেখে ভূতের মতো সাদা হয়েছে, আটার দলা গোল গোল টিপের মতো তৈরি করে বিছানার চাদর নষ্ট করেছে, প্যাস্টেলে আঁকিবুঁকিতে দেওয়ালের বহুমূল্য রং নষ্ট করেছে। কিন্তু, এমনভাবে চোখের পাতা আটকে ধরাশায়ী হয়নি কখনও। তার চোখে সরু সুতোর মত চুয়িংগামের অংশবিশেষ এমনভাবে সেঁটে গেছে যে নারকেল তেলেও উঠছে না। একদিকে তুলছে তো আরেকদিকে লেগে যাচ্ছে। নাজেহাল মা এবার চড় কষিয়ে দেয়। ভয়ে ও উত্তেজনায় কান্না আরও গেলো বেড়ে যায় খুশির। অবশেষে অনেক সাধ্য-সাধনায় ঠাকুমা নারকেল তেল দিয়ে ধীরে ধীরে চোখের গাম ছাড়িয়েছে। পাক্কা জহুরির মতো ঠাকুমা বলল–সত্যি কথা বলতো খুশি কেমন করে চুয়িংগাম চোখে আটকে গেল ? জবাব না দিয়ে ছুটে চলে যায় খুশি ।
গোয়ালঘরের বাঁদিকের কোনে কাঠের একটা বড় ঝুড়ির মধ্যে কেলিটা রোজ ঢুকে যাচ্ছে। সারাদিন বের হচ্ছে না । মাঝে মধ্যে ইতিউতি তাকিয়ে টুক করে বের হয় খুব কম সময়ের জন্য। তারপর শান্ত হয়ে বসে থাকে সারাদিন। এসব কী ওর পছন্দ হয় ? কোথায় ও ছুটবে, দৌড়বে, কখনও উড়াল দেবে–তা না করে গোয়াল ঘরে চুপটি করে বসে থাকা! একসময় নাকি এই বাড়িতে গরু ছিল। এখানেই গরু থাকত। সেই থেকে গোয়ালঘর আছে। বাড়ির বাতিল মালপত্তর, হাবিজাবি সব স্তূপাকারে এখানেই থাকে।
গোয়ালঘরের একপাশে সার দেওয়া কয়েকটি কাঠের বাক্সে হাঁস-মুরগীর অবস্থান। সারাদিন ওরা বাইরে চরে বেড়ায় আর সন্ধ্যায় যে যার বাক্সে এসে ঢুকে পড়ে। হাঁসগুলো বাড়ির সামনের পুকুরেই ভাসে। ডুব দিয়ে দিয়ে স্নান করে। ওদের কত বন্ধুবান্ধব! ধীর ও শান্ত হয়ে মাথা এদিক ওদিক ঘুরিয়ে নিজেদের মধ্যে গল্প করে। পাড়ে এসে ডানা ঝাপটায়। পোকামাকড় ও গেরিগুগলি খায়। পুকুর পাড়ে বা উঠানে পচ পচ পায়খানা করে। সে করুক। এই ক্ষুদে প্রাণীগুলো খুশির খুব প্রিয়।
মুরগীরা এর ওর আগানে বাগানে ঘুরে বেড়ায়। সরু সরু পা দিয়ে নোংরা থেকে পোকামাকড় খুঁটে খুঁটে খায়। মাঝে মাঝে খুশি ওদের মুড়ি ও বিস্কুট দেয়। হা করে ঠোঁট ফাঁকা করে টপাটপ খেয়ে ফেলে ওরা। ভোরবেলায় লাল ঝুঁটিওয়ালা মোরগটা কী সুন্দর কোকরও কক বলে ডেকে ঘুম ভাঙায় তার। গরু নেই বলে মন খারাপ হলেও হাঁস-মুরগীদের ওপর ওর খুব মায়া খুশির। তিয়া খুশির বন্ধু। ও আর তিয়া মিলে সকলের নাম দিয়েছে–লিলি, মিলি, কেলি ও তিলি। বাড়ির কেউ সেসব জানে না। বাবাকে বলতে গিয়ে বাবা বলে–তোর যত পাগলামো। ডিমের জন্য এগুলো পুষছি। ডিম দেওয়া বন্ধ হয়ে গেলে কেটে খেয়ে ফেলব। খুব দুঃখ পায় খুশি। বলে কিনা–দেশি হাঁস-মুরগীর টেস্ট বেশি।
সকালবেলায় ঘুম থেকে উঠেই ওদের একবার দেখে এসে তারপর পড়তে বসে ও। কিন্তু আজ বড় বিমর্ষ খুশি। লিলি, মিলি, কেলি ও তিলির মধ্যে কেলি ডানা বিছিয়ে চুপচাপ পরে আছে। ও অসুস্থ বলে বড় ঝুড়ির মধ্যে মা ওকে আলাদা রেখেছে। কই মা তো কিছু বলছেই না। খুশির সামান্য জ্বর হলে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যায়। কিন্তু মুরগীর বেলায় এতো উদাসীন ! আজ রবিবার, তাই সারাদিন বাড়িতে থাকবে ও। তিয়াকে কেলির কথা বলতেই তিয়া একটা ভালো পরামর্শ দিলো–দুপুরবেলায় যখন বাড়ির সবাই ভাতঘুম দেবে, তখন দুজনে পর্যবেক্ষণ করে দেখবে, কেলির সমস্যাটা ঠিক কোথায়!
যথারীতি খুশি দুপুরবেলায় চুপি চুপি তিয়াকে নিয়ে গোয়ালঘরে হাজির। ঘাড় গুঁজে দুদিকে কালো কুচকুচে ডানা মেলে ঘুমোচ্ছে কেলি। ওদের শব্দ পেয়েই গুড়িগুড়ি দুটো চোখ দিয়ে দেখে, আবার চোখের পর্দা টেনে নিল। যেন পাত্তাই দিচ্ছেনা ওদের। কৌতূহলী তিয়া আস্তে করে হাত ঢুকিয়ে দিল ঝুড়িতে। তারপরই ‘আঃ’ করে হাত বের করে আনল ঝটকা মেরে। কেলি ঠুকরে দিয়েছে ওকে। হাত থেকে রক্ত বেরিয়ে এলো তিয়ার। খুব সম্মানে লাগলো খুশির। ওরই বন্ধুকে ওর বাড়ির মুরগী কামড়ে দিল ! অথচ কেলিকে সে কত খাবার দেয়! নিজের বিস্কুট, কেক, মুড়ি যা খায়, তাই দেয়। কোনও কৃতজ্ঞতা নেই ওর ? সে ঝুঁকে পড়ে ঝুড়ির উপর। জোর করে কেলিকে টেনে তোলার চেষ্টা করল। তেলি তো ঘাপটি মেরে বসে আছে। ইস ! কী হবে তবে ! ও কী আর বাঁচবে না ? শরীর খারাপ হলে তো ডিমও দেবে না। বাবা বলেছিল যে ডিম না দিলে, ওকে মেরে খেয়ে নেবে। চিন্তার বিষয় !
এরপর খুশি নিজেই ঝাঁটার কাঠির খোঁচা দিয়ে বিরক্ত করা শুরু করে। কোনও না কোনভাবে ওকে তুলতেই হবে। উঁহু, কুঁকড়ে যাচ্ছে কেলি, তবু উঠছে না। এবার ছোট্ট একটা কাঠের টুকরো এনে পায়ের কাছে খোঁচাখুঁচি করতে লাগল খুশি। পায়ের নিচ থেকে কী যেন রসের মত গড়িয়ে এলো। উফফ! কী ভোঁটকা গন্ধ! কেলি এবার হিংস্র হয়ে জাপটে ধরল খুশির হাত। কামড়ে, ঠুকরে রক্ত বের করে দিলো। যন্ত্রণায় চিৎকার করে উঠল খুশি। কেলিও গগন বিদারি চিৎকার করতে লাগল। ছুটে এলো খুশির মা। মেয়ের কচি হাত দিয়ে তখন রক্ত গড়াচ্ছে। সব দেখেশুনে ঠাস ঠাস করে চড় মারল মা, বলল–জানিস না ও ডিমে তা দিচ্ছে ! কেন ওকে বিরক্ত করতে গেলি ! কাঁদতে কাঁদতে খুশি বলল–ওর তো শরীর খারাপ। খায় না, দায় না, শুধু বসে থাকে বলে ওকে ঝুড়ি থেকে বের করতে চেয়েছিলাম। মা রেগে বলে, খুব কাজ পেয়েছ তাই না ? ভাজা ভাজা করে ফেললি আমাকে। খুশি এখনও বুঝতে পারেনি যে ওর ভুল কোথায় ? ভয়ে যন্ত্রণায় চুপ করে থাকে খানিক। মাথার মধ্যে একটাই চিন্তা–বাবা দেশি মুরগীর রোস্ট করে ফেলবে নাতো?
এরপর ঠাকুমা এসে হাতের ক্ষতবিক্ষত জায়গায় বোরোলিন দিতে দিতে বলল–এইজন্যই চুয়িংগাম চোখে আটকে গিয়েছিল সেদিন ! ধরা পড়ে গিয়ে খুশি বলল–কেলিটা সামনে গেলেই কামড়াতে আসছিল। তাই ওর চোখটা চুয়িংগামে আটকানোর আগে, নিজের চোখে লাগিয়ে প্র্যাকটিস করছিলাম। ওকে চোখ বন্ধ করে বাইরে আনতে চাইছিলাম যে। ঠাকুমার মাথায় হাত ! দুজনকে বুঝিয়ে বলল–হাঁস-মুরগীর ডিম থেকে কীভাবে কচি কচি ছোট্ট ছোট্ট ছানা বের হয়। একুশ দিন ওরা নাওয়া খাওয়া ভুলে ওদের ডিমগুলোর উপর যত্ন করে বসে থাকে। ওদের শরীর থেকে ওম বের হয়। তিয়া অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করে–ওম কী ? ওম হল পাখীদের শরীর থেকে বেরোনো গরম, যা ডিমের কুসুমকে বাচ্চা তৈরিতে সাহায্য করে–বলে ঠাকুমা।
খুশি সত্যিই এবার দুঃখ পায়। খুব বিরক্ত করেছে কেলিকে। ওর ওম বেরোনোতে ডিস্টার্ব করেছে। তবে কি আর বাচ্চা হবে না–এবার আশঙ্কা হচ্ছে তার। ঠাকুমা বলল, কয়েকটা ডিম তো খুঁচিয়ে নষ্ট করেছিস। তাই ওগুলো বাদ দিয়ে অন্যগুলো হয়তো হবে। আর কদিন অপেক্ষা করতে হবে ঠাকুমা –জানতে চায় খুশি। ঠাকুমা বলে–আজ তো মোটে দশ দিন। আরও এগারো দিন পর বোঝা যাবে। ততক্ষণে সন্ধ্যা হয়ে গেছে। বাড়ির হাঁস-মুরগীগুলো নিত্যদিনের মত শব্দ করে করে বাড়ি ফিরেছে। তারপর যে যার বাক্সে ঢুকে যাচ্ছে। কেলির ঝুড়ির দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইল খুশি আর তিয়া। এগারো দিন বাদে সারা বাড়ি জুড়ে খেলে বেড়াবে তো কদমফুলের মত ছোট্ট ছোট্ট মুরগীর ছানা ?!
পাঠকদের মন্তব্য
250