ছোটোদের চাঁদের হাসি / গল্পগাথা / ফেব্রুয়ারি ২০২৫

দোয়েল নামের সেই নদীটি

     আমি যে একটু একটু করে বড়ো হয়ে উঠছি মা সেটা বুঝতেই পারেনি। একটা স্বপ্নমাখা নদী তখন আমার চোখের সামনে। দোয়েল নামের সেই নদীটি। সেই নদী কখনও খিলখিল করে হাসে, কখনও টলটলে হরিণচোখে আমার দিকে তাকিয়ে মিটিমিটি চেয়ে থাকে।

    সেই নদী আবার কখনও ফিনফিনে বাতাস, কখনও খুশির ঝিলিক। কখনও কথার ফুলঝুরি, কখনও উতল ঢেউ। এলোমেলো হাওয়া, ঝলমলে কাশফুল। বুকের ভিতরে তখন উৎসবের হামাগুড়ি। স্পষ্ট বুঝতে পারি এক অদ্ভুত রোদ-বৃষ্টি, আলো-আঁধারে আমি একটু একটু করে বড়ো হয়ে উঠছি।

 

    এই যে একটু একটু করে বড়ো হয়ে ওঠা-–এই সময়টা বড়ো অচেনা। অনেক সময়ে আমার নিজের কাছেও। আমার চেনা-অচেনার আঁকেবাঁকে সেই নদীও তখন পাক খায়। তিরতির করে ঢেউ তোলে বুকে, হারিয়ে যায় দুপুর।

    সেই নদীতে ইলশেগুঁড়ি ওড়ে, দোল খায় বাতাস, ঝরে পড়তে থাকে এক আকাশ খুশি। তখন মন খারাপের মেঘও কেটে যায় নদীর কাছে এলে। মায়ের বকুনি, ইস্কুলে পড়া না পারার বেদনা, বাবার আগুন চোখ সব হঠাৎ হঠাৎ করে কীভাবে যেন উধাও হয়ে যায়। এসব তখন অতি তুচ্ছ। তখন মনের ভিতরে শুধু শিশির ভেজা হিমেল হাওয়া, ছেঁড়া ছেঁড়া জোছনা, খুশিতে টইটম্বুর।

    এই সময়টা বুঝি শুধু স্বপ্ন দেখার, স্বপ্ন মাখার। মনের ভিতরে ছায়াকল–নদীর সঙ্গে শব্দহীন কথোপকথন, বুকের ভিতরে ঘাই মারে একরাশ কৌতূহল।

 

     এদিকে শীত ফুরোতে না ফুরোতে, হালকা গরম পড়তে না পড়তেই শুরু হয়ে যায় সত্যিকার নদীর ঘাটে জটলা–সকাল-বিকেল। নদী তখন প্রতিদিনই একটু একটু করে দূরে সরতে থাকে। এপার ওপার দুই পারেতেই, কৃষকেরা বাঁশ-বাতায় ঘেরা নিজের নিজের জায়গায় গরমের সবজি ফলানোর উদ্যোগে ব্যস্ত।

     এপারে বুড়ো পাকুড়গাছের তলায় আমি যখন ওপারের দিকে উদাস তাকিয়ে, তখন আকাশটা ঠিক আমার পিছনেই থম দাঁড়িয়ে। দূরে-অদূরে আবছা নিমাইসরা, আম্রমুকুলের গন্ধ। পাশেই রেলব্রিজ ঝমঝম। আমার দুচোখে কে যেন স্বপ্ন এঁকে দেয়–ছায়ায় ঘেরা ঝিকমিক, পাকুড়-পাতার ফাঁক দিয়ে চুঁইয়ে পড়া এক চিলতে রোদ, বালি চিকচিক এক অবাক করা নদী । নদীর বুক ঠেলে তখন ঘাই মারে মস্ত এক চিতল কিংবা বড়োসড়ো এক বোয়াল। কখনও দূর থেকে ভেসে আসে গাজনের শব্দ। বুঝি গরম আসছে। ধীর পায়ে অথবা দ্রুত। আমার বুকের ভিতরে তখন গাজন আর নদীর ঢেউ দুয়ের মিলনে ঝাঁপাঝাঁপি। 

 

   এই না-শীত না-গরম সময়ের প্রতিটি বিকেলই অবাক করা বিকেল। কখনও রোদ, কখনও বৃষ্টি। কখনও ঝড় ও বৃষ্টি দুইই। এরকমই একদিন, শেষ দুপুরের ছোট্টো এক কালবৈশাখীর পরে খুশির আভা ছড়িয়ে পুব আকাশে ভেসে ওঠে রামধনু। সত্যি রূপজৌলুসে যেন রাজকন্যা।

 

     সেদিনই প্রথম একটা পাখির ডাক শুনে আমি চমকে উঠি। সেদিনই প্রথম দেখি ওকে। নদীর চরে। শেষ বিকেলে নদীর গা বেয়ে একটু একটু করে উঠে আসছে। ছোট্টো ছোট্টো পায়ে। যেন শান্ত গোলগাল পূর্ণ চাঁদের মতো ঢলঢলে আলো করা ফরসা একটি মুখ। ভিজে চুপচুপ। মেঘবরণ চুল আর কুঁচবরণ কন্যা। আমার বুকের ভিতরে তখন একটা ছোট্টো কাঁপুনি, এক ঝলক দমকা বাতাস। ধুকপুক। তারপরে ঢেউ। মাছরাঙা, গাঙচিল উড়তে থাকে আকাশে।

 

    তারপর থেকে রোজ ওকে দেখতে থাকি। বারে বারে দেখি। ফিরে ফিরে দেখি। পাখির শিস কানে ভেসে আসে। বুঝতে পারি এক অন্যরকম মায়াজালে জড়িয়ে পড়ছি। আমার বুকের ভিতরে তখন দোয়েলের  ছলাৎ ছলাৎ শব্দ, জল-মাটি-আকাশ চুঁইয়ে জীবন তখন কখনও ছেঁড়া ছেঁড়া মেঘ, কখনও আকাশ জুড়ে লাল-হলুদ-নীল-সবুজ ঘুড়ির ওড়াওড়ি, ঘুড়ির মেলা। আমিও সেই ঘুড়ির ভিড়ে কখনও আকাশে উড়ছি। উড়ছি। উড়ছি। উড়তে উড়তেই তখন একমনে দেখছি দোয়েলকে। আমার মিষ্টি দোয়েলকে। আর শুনছি দোয়েলের তিরতির করে বয়ে চলা ঝিরিঝিরি শব্দ। আমি তখন শুধু পাখির ডাক শুনি। দোয়েলের।

    দোয়েলও তখন ঝিরঝিরে বাতাস, খুশিতে ইলিক ঝিলিক। হাসিখুশি এক নদী।

 

     বিকেল হলেই আমি তাই নদীতে। সেই পাকুড়তলায়। নদীর ঢালে তখন রীতিমতো চাষ। পটল, ছোলা, ঝিঙে, শশা। আমি কখনও নদীর বাঁধ ভেঙে, খেতজমি ডিঙিয়ে, জমিটা যেখানে ঢালু হয়ে শেষে একদম জলে গিয়ে মিশেছে সেইখানে।

     এই জায়গাটা ভারী সুন্দর। নিচে নেমে পিছন ফিরে বাঁধটাকে দেখে অবাক হই। বর্ষার সময়ে তো ওই অবধি জল ওঠে। তারপর থেকেই একটু একটু করে নামতে থাকে। বর্ষার সময়ে আমরা আসি না। কিন্তু যখন আসি, দেখি তখন কত নিচে নেমে গেছে দোয়েল। দোয়েল কিন্তু এখন এইসময়ে, এখানটাতেই বেশি সুন্দর। সবচেয়ে সুন্দর। কেমন যেন নরম ও অবাক করা শান্ত। টলটলে চোখে স্বচ্ছ জল। সেই জলের নিচে ঢেউখেলানো বালির জমি। রবিকিরণে চিকচিক, কুচো মাছের খেলা সেখানে। আমি একটু একটু করে নেমে পা ভেজাতে থাকি সেখানে।

 

   এরকম একদিন নয়, প্রতিদিন। আর প্রতিদিনই দোয়েলকে দেখি ভিন্ন ভিন্ন রূপে। প্রতিদিনই যেন দোয়েলের মধ্যে বদল হতে থাকে। এই বদলের রহস্য আমি কিছুতেই বুঝে উঠতে পারি না। এই কথাগুলো একদিন মাকে বলি। বলি, দোয়েলের কথা, পাখির শিষ শোনার কথা, নদীবুকের খোলামেলা বাতাসের কথা, মাথার উপর দিয়ে ভেসে চলা মেঘেদের ওড়াওড়ির কথা।

     আমার মুখে সব শুনেটুনে মা বললেন, তাহলে একদিন চল। আমিও যাব তোর সঙ্গে। দেখব নদীকে। দেখব তোর দোয়েলকে। শুনব পাখির ডাক, পাখির শিষ।

 

     একদিন সত্যি সত্যি চেনা-অচেনা চড়াই-ফিঙে-ছাতার পাখির কিচির-মিচিরের কলস্বরের ভিতর দিয়ে মা এলেন আমার সঙ্গে। মা এসে চারপাশে দেখতে থাকলেন। মা দেখছে হলুদ বিকেল। দোয়েল তখন ভয়ে জুজুবুড়ি, মুখে আঙুল। চুপ। পাকুড়পাতা শুকিয়ে দুটো-একটা করে ঝরে পড়ছে। মা সেসব মুচমুচ মাড়িয়ে একদম নদীর কাছে। চারদিকে তাকিয়ে আমাকে শুধালেন, কোথায় তোর দোয়েল? কোথায় সেই পাখির ডাক? কোথায় তোর পাখির শিষ?

 

     আমি তো মায়ের প্রশ্নে অবাক। আমি তো আমাদের চারদিকেই বুনো ফুলের সুগন্ধ টের পাচ্ছি। মাথার উপরে ঝাঁক ঝাঁক পাখি, নদীর বুক চিরে এপার থেকে ওপারে উড়ে যাচ্ছে একদল সবুজ টিয়া। আর এর মধ্যেই দোয়েল এক পা এক পা করে এগিয়ে আসছে আমার দিকে। ও তখন সত্যিই রাজকন্যে, রাজকুমারীর মাথায় মোতির ফুল। আমার দিকে এক মুখ আলোর ছটা ছড়িয়ে, বন্ধুত্বের দু-হাত বাড়িয়ে এগিয়ে আসছে। আমি মাকে বলি, মা দেখতে পাচ্ছো?

     মা অদ্ভুত চোখে আমার দিকে তাকালেন। আমিও মায়ের দিকে তাকাই। তারপর আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, এই বয়সে এরকম হয়। কেউ দেখে নদী, কেউ দেখে দোয়েল। আবার কেউ শোনে পাখির ডাক, পাখির শিষ। কিন্তু এসব দেখলে হবে? এসব শুধু ভাবলে হবে? সামনেই পরীক্ষা , তার প্রস্তুতি নিতে হবে তো! এখন নিজেকে তৈরি করার সময়। চলো, ঘরে চলো। এখন দোয়েলের কথা না ভাবলেও হবে।

 

   অতএব মায়ের সঙ্গে আমিও পা বাড়াই। কিন্তু সত্যি বলছি, মা কেন আমার দোয়েলকে দেখতে পাচ্ছে না! আমি তো দেখছি। আমি তো সবসময়েই নদী, দোয়েল, পাখির ডাক, শিষের শব্দ নিয়ম করেই শুনতে পাই। মা আমার কাছে, পড়ার টেবিলে বসে থেকেও কেন দোয়েলকে দেখতে পায় না? কেন শুনতে পায় না তার তিরতির করে বয়ে চলার ঝিরঝিরি শব্দ? আমি জানি না। অথচ আমি দেখি, কান পেতে দোয়েলের শিষ শুনি।

     দোয়েল আমার কাছে প্রথম আলো।

 


পাঠকদের মন্তব্য

কোন মন্তব্য পাওয়া যায়নি

আপনি কি এই লেখায় আপনার মন্তব্য দিতে চান? তাহলে নিচে প্রদেয় ফর্মটিতে আপনার নাম, ই-মেইল ও আপনার মন্তব্য লিখে আমাদের পাঠিয়ে দিন।
নাম
ই-মেইল
মন্তব্য

250

    keyboard_arrow_up