ছোটোদের চাঁদের হাসি / গল্পগাথা / ডিসেম্বর ২০২৩

পুপলুর রঙের প্যালেট

পুপলু সবে ক্লাস ফোরে উঠেছে। উঠতে না উঠতেই বাবা এনে দিয়েছে একটা আঁকার খাতা আর অনেকগুলো প্যাস্টেল। পুপলু আসলে ছবি আঁকতে খুব ভালোবাসে। পড়ালেখার মাঝে সুযোগ পেলেই বসে ছবি আঁকে। কখনও পাখি, কখনও পাহাড় নদী এইসব। এর ভিতর বাবার সঙ্গে তার এক মজার খেলা আছে। সে হলো রঙের খেলা। সেদিনের জন্য কার প্রিয় রঙ কি বলতে হবে। তারপর এঁকে ফেলতে হবে সেই রঙ দিয়ে একখানা ছবি।

 

পুপলুর বাড়ির পাশ দিয়ে বয়ে চলেছে রূপনারায়ণ। বর্ষায় ফুলে ফেঁপে উঠলেও অন্য সময় নদীটা বেশ শান্ত থাকে। রূপনারায়ণের ধারে, ঠিক পুপলুর বাড়ির পাশে নানান রঙের ঘাসফুল ফুটে থাকে। পুপলু সেসব মন দিয়ে দেখে আর এঁকে ফেলে। রোগী দেখার ফাঁকে বাবা টুকি মেরে দেখে যায় পুপলুকে। পুপলু মুচকি হেসে জিজ্ঞেস করে, "আচ্ছা বাপি,আকাশের রঙ নীল কেন?"

“নীল রঙের তরঙ্গদৈর্ঘ অতিবেগুনির মতো অত কম না হয়েও, এমন যে, অনেকটা ছড়িয়ে যেতে পারে তাই। আজ বুঝি তোমার প্রিয় রঙ নীল?”

বাবার কথায় পুপলু ঘাড় নাড়ে। আজ সে নীল দিয়ে আঁকবে।

 

এদিকটায় একটা মজা আছে। শীতকালে হুট করে ঠাণ্ডা পড়ে যায়। তখন পুপলু সোয়েটার গায়ে চড়িয়ে বসে থাকে। সেইসব সোয়েটার সব একসময় বাবা পরেছিল। হাতে বানানো। ঠাকুমা উল দিয়ে ভারি সুন্দর সোয়েটার বুনতেন। আজকাল তো আর কেউ উল বোনেই না। সব তৈরি সোয়েটার। বিকেলে একদিন বিবার হাত ধরে বাজারে গিয়ে পুপলু দেখল নানান রঙের মাছ। আবার তাদের সব নানানরকম দেখতে। একটা মাছ তো অবিকল সাপের মতো। বাবা বলল, ওটা বান মাছ।

 

বাজারে সোয়েটার বিক্রি হচ্ছিল। বাবা বলল,"নিবি? বল কোনটা পছন্দ?"

পুপলু ঘাড় নাড়ল। তার একটা সোয়েটারও পছন্দ হয়নি। বাবা মুচকি হেসে বলে,"বুঝেছি। হাতে বোনা না হলে বাবুর মনে ধরে না বুঝি।" আসলে পুপলু বাবার সোয়েটার গায়ে দিলে বাবার ছেলেবেলার গন্ধ পায়। সেসব গল্প সে ঠাম্মার মুখে শুনেছে কত ! একটা সোয়েটারের ওপর টিয়াপাখি আঁকা। বাবা ওটা পরে রূপনারায়ণের জলে ব্যাঙাচি খেলতে যেত। ছোটবেলায় বাবার ছিল ঘুড়ি ওড়াবার নেশা। সেই দেখে ঠাম্মা বাবার জন্য একটা ঘুড়ি আঁকা সোয়েটার বুনে দিয়েছিল। পুপলু তো মাকে তেমন পায়নি। সেই ছোটবেলায় মা বিদেশ চলে গেল। আর এলো না। কিন্তু ঠাম্মা কখনও বুঝতেই দেয়নি মা নেই। তারপর হঠাৎ একদিন ঠাম্মাও ফটো হয়ে গেল।

 

পুপলুবাবুর বুঝি মন খারাপ?

বাবা বাড়ির লাগোয়া ঘরেই চেম্বার করে। আজকাল আর কোথাও যায় না তাকে ছেড়ে। কখন যে রোগী দেখা শেষ করে চলে এসেছে!

“কৈ। না তো!” বাবার কথার জবাবে বলে পুপলু।

বলো তো। সব বিপদের রঙ লাল হয় কেন?

লাল রক্তের রঙ বলে।

নারে পুপলু। আসলে লাল রঙের তরঙ্গদৈর্ঘ্য সবচেয়ে বেশি। এতো বেশি যে সে কিছুতেই ছড়ায় না। অনেক দূর থেকে তাকে দেখা যায়। তাই।

সব রঙেরই বুঝি তরঙ্গদৈর্ঘ্য  থাকে?

থাকেই তো। তা তোমার আজকের পছন্দের রঙ কী শুনি?

পুপলু ভাবতে ভাবতে একটা হলুদ রঙের প্যাস্টেল তুলে নিল। তারপর বাবাকে বলল–

আর তোমার?

আমারও তাই। হলুদ।

আচ্ছা বাবা। আজকের দিনেই তো ঠাম্মা হঠাৎ …!

বাবা কিছু বলল না। তাকিয়ে রইল দেয়ালে টাঙানো ছবিটার দিকে। সেখানে উলকাঁটা হাতে হলুদ বালুচরী শাড়ি পরে ঠাম্মা বসে আছে। বাবা হঠাৎ পুপলুকে জড়িয়ে ধরল। মাথার ওপর দুফোঁটা জল পড়তেই পুপলু বুঝল তার বাবা কাঁদছে। প্যাস্টেলের মতোই পুপলুর মনে হলো, মানুষের মনেরও এক একটা রঙ আছে। আজ তার আর বাবার মনের রঙ এক তরঙ্গদৈর্ঘ্য পেয়েছে। তাই তারা প্যালেটে মিলেমিশে একাকার। বর্ষার রূপনারায়ণ আর তার চর যেমন জলতরঙ্গে মিশে যায়।


পাঠকদের মন্তব্য

কোন মন্তব্য পাওয়া যায়নি

আপনি কি এই লেখায় আপনার মন্তব্য দিতে চান? তাহলে নিচে প্রদেয় ফর্মটিতে আপনার নাম, ই-মেইল ও আপনার মন্তব্য লিখে আমাদের পাঠিয়ে দিন।
নাম
ই-মেইল
মন্তব্য

250

    keyboard_arrow_up