কাঁঠাল পাতা
আশিস কর্মকার
একদিন সকালে ছাগু তার ছানাদের বলল, এই শোন, কাল থেকে আমি আর বাইরে বেরোচ্ছি না। তোরা বড় হয়েছিস। এবার থেকে তোরাই আমাকে বাইরে থেকে খাবার জোগাড় করে এনে খাওয়াবি। বুঝলি?
এ কথা শুনে ছাগলের প্রথম ছানা এক্কা বলল, কেন মা, তোমার শরীর খারাপ?
ছাগু বলল, না, না, শরীর খারাপ হতে যাবে কেন? আমাকে দেখে কি তাই মনে হচ্ছে? আসলে তোরা তো বড় হয়েছিস। এখন দেখি তোদের কার কত বুদ্ধি-শুদ্ধি হলো, কতটা শিখতে পারলি।
অ…এই বলে মুখ ব্যাজার করে চুপ করে গেল এক্কা। ব্যাপারটা তার ভালো লাগল না মোটেই। বেশ ছিল। মা জোগাড় করে এনে দিচ্ছিল ওরা খাচ্ছিল। এই তো ভাল ছিল। কিন্তু এ আবার কী?
ছাগুর দ্বিতীয় ছানা দোক্কা আবার এক কাঠি উপরে। সে সামনের ডান পা তুলে দেখিয়ে বলল, আমার তো মা পায়ে ব্যথা। আমার হাঁটতে কষ্ট হয়। ছাগু বলল, ওতে কিছু হবে না। আমাদের এরকম অনেক কষ্ট মেনে নিতে হয় বাছা। কাল যাবি। যেখান থেকে পারিস খাবার জোগাড় করে আনবি।
এবার ছাগু তার তিন নম্বর ছানার দিকে তাকিয়ে বলল, কিরে তিনু, পারবি তো ?
এক্কা আর দোক্কা যেমন মায়ের দুধ পেট ভরে খেয়ে বড় হয়েছে, তিনু আবার তা নয়। অনেক ছোটবেলাতেই সে দুধ খাওয়া ছেড়ে দিয়ে লাফালাফি করতে শুরু করেছে। এভাবেই সে বড় হয়েছে। সেই তিনু একটু দূরেই বাসার এক কোণে লম্পঝম্প করছিল। বলল, হ্যাঁ মা, তুমি চিন্তা করো না। আমি ঠিক পারব।
ছাগু সবার দিকে তাকিয়ে বলল, তিনু পারবে বলেছে। ও পারলে তোরা পারবি না কেন? কাল সবাই বেরোবি।
আচ্ছা মা, বলল এক্কা আর দোক্কা।
এক্কা আর দোক্কাকে তিনুর কথা বললেও, তিনুর প্রতি ছাগুর কোনও ভরসা নেই। একটা কাজ করতে বললে সে ওই কাজটা ভন্ডুল করে ছাড়ে। এইতো সেদিন, ওদের জল খাওয়ার মাটির ভাণ্ড থেকে জল খেতে গিয়ে ওর লম্ফঝম্পের চোটে ভাণ্ডটা তো গেল উল্টে, আবার ভেঙেও গেল। ফলে তার জল তো খাওয়াই হলো না। আর সেই সঙ্গে জুটল মায়ের বকাঝকা।
পরদিন সকালে যথারীতি ওরা তিনজনেই বেরিয়ে পড়ল খাবার জোগাড়ে। তারা নিজেরা কিছু খাবে। তারপর নিয়ে আসবে মায়ের জন্য। এমনটাই বলে দিয়েছে মা। আর বলেছে যেন বেশি দূরে না যায়।
বাইরে বেরিয়ে এক্কা বলল, আমি বেশি দূরে যাব না ভাই। আমার বড্ড ঘুম পাচ্ছে।
দোক্কা বলল, এই এক ঝক্কি। ছিলাম ভালই। তা না, এখন খাবার জোগাড়ে চলো। হুঃ।
কিছুটা এগিয়ে সামনেই দেখল একটা মাঠে সুন্দর ঘাস রয়েছে। কচি কচি। সকালের নরম রোদ ঘাসের আগায় পড়ে সোনালী রং ধরেছে তাতে। সে ঘাস দেখে লোভ হওয়ারই কথা। এক্কা জিভ দিয়ে ঠোঁট কেটে বলল, আমি আর কোথাও যাব না, এখানেই খাই। এই বলে সে ঘাস খাওয়া শুরু করল। দোক্কাও তাই করল। তিনু বলল, তোরা এখানে খা। আমি একটু ওদিকটায় যাচ্ছি। এই বলে সে ওখান থেকে চলে এল।
চলার পথে তিনু দেখল একটা বাছুর ঘাস খাচ্ছে। সে আগে কখনও বাছুর বা গরু দেখেনি। তাই সে অবাক হয়ে ঘাড় কাত করে বাছুরটার দিকে তাকিয়ে রইল।
বাছুরটা খেতে খেতেই আড় চোখে তিনুকে লক্ষ্য করছিল। কিছুক্ষণ পর খাওয়া থামিয়ে জিজ্ঞেস করল, কিরে কি দেখছিস?
না, দেখছি তুইও তো আমার মতনই ঘাস খাস, বলল তিনু। বাছুরটা বলল, হ্যাঁ খাই তো।
তুই কী এই ঘাস খেয়েই এত বড় হয়েছিস?
হ্যাঁ। এই ঘাস খেয়েই তো এত বড় হয়েছি।
তিনু মনে মনে ভাবল, বাহ, বেশ তো! এ ঘাস খেলে আমিও ওর মতন বড় হয়ে যাব।
বাছুরটা বলল, এরপর আমি খড়-বিচুলি খাব। তখন আরও বড় হয়ে যাব। বাবার মতন। ওই দ্যাখ–
তিনু দেখল কিছুটা দূরে বাছুরটার মতনই একটা বিশাল চেহারার কালো গরু গাছের ছায়ায় বসে চোখ বুজে জাবর কাটছে। গরুটার শিং-এর ওপরে একটা বক বসে তার লম্বা ঠোঁট দিয়ে গরুটার কানের ভিতর ঢুকেছে। সুড়সুড়ির চোটে গরুটা মাথা নাড়ালে বকটা উড়ে গিয়ে আবার কিছুক্ষণ পরে এসে বসছে শিং-এর ওপর।
গরুটা চোখ বন্ধ করেই জিজ্ঞেস করল, কী হলো রে বাছু? বাছু তার ছানার নাম।
বাছুরটা বলল, আমি…তারপর তিনুকে জিজ্ঞেস করল, এই তোর নাম কী রে?
আমার নাম তিনু।
তিনুর নাম জেনে নিয়ে বাছু তার অসম্পূর্ণ কথা সস্পূর্ণ করল, আমি তিনুর সঙ্গে কথা কইছিলাম বাবা। ও জিজ্ঞেস করছিল আমি কী খেয়ে বড় হয়েছি।
এবার গরুটা চোখ খুলে তিনুকে দেখে গম্ভীর গলায় বলল, ও… ছাগুর ছানা।
গরুটার মুখে তার মায়ের নাম শুনে তিনু তো অবাক। বলল, আপনি আমার মাকে চেনেন?
চিনি বৈকি। আমরা তো একই সঙ্গে ঘাস খাই।
তিনু আরও অবাক হয়ে বলল, আপনারা একসঙ্গে ঘাস খান, একই ঘাস খান, তবে আমার মা-বাবা আপনাদের মতন বড় তো নয়! এত ছোটো ছোটো কেন?
আসলে তোরা এক আর আমরা আর-এক। তোরা যতই ঘাস খা, আমাদের মতন বড় হতে পারবি না।
তিনু ভেবেছিল যে, ভালো-মন্দ খেয়ে বাছুর বাবার মতই সে-ও অনেক বড় হবে। কিন্তু যখন সে শুনল যে তার বাবা-মা বাছুর বাবার মতন একই খাবার খেলেও বড় হতে পারবে না, তখন তার মন খারাপ হয়ে গেল।
গরুটা জিজ্ঞেস করল, তা তুই কোথায় চলেছিস এখন?
তিনু বলল, মা বলেছে আমাদের নিজেদের খাবার যোগাড় করতে। তাই চলেছি ভালো খাবারের খোঁজে।
গরুটা মাথা নাড়িয়ে বলল, এটা ছাগু ভালো করেছে। ছানাদের নিজেদের খাবার নিজেদের যোগাড় করা শিখতে হবে বৈকি। আর সেটা এখন থেকেই ট্রেনিং হওয়া চাই। এই আমি যেমন বাছুকে নিয়ে বেরিয়েছি। কয়েকদিন পর ওকে একাই ছেড়ে দেব। চড়ে চড়ে খাবে। কিন্তু,তোরা মানে? তোর আর ভাই-বোনরা কোথায়?
ওরা তো ওদিকে ঘাস খাচ্ছে।
তা, তুই ঘাস খাচ্ছিস না কেন?
আমি তো আগেই ও ঘাস খেয়েছি। ওরা খায়নি।
গরুটা বুঝতে পারল যে এ ছাগুর তিন নম্বর সন্তান। মায়ের দুধ বেশিদিন খায়নি, লাফাতে লাফাতেই বড় হয়েছে। তাই সে বলল, শোন, তোকে একটা ভালো খাবারের জায়গা বলি। এখান থেকে মিনিট দশেক সোজা হেঁটে চলে যা। একটা নদী পড়বে। নদীর ধারে অনেক বড় বড় কাঁঠাল গাছ আছে। সেখানকার কাঁঠাল পাতা খেতে পারিস। বড়ো সরেস পাতা। তোদের তো কাঁঠাল পাতা প্রিয় খাবার।
তিনু ভাবল, ঠিক কথা। এটা কেন এতক্ষণ মাথায় আসেনি? মা’র মুখে একবার শুনেছিল বটে কাঁঠাল পাতার কথা। একবার দেখেওছিল। বলল, হ্যাঁ, সেই ভালো। মা একদিন বলছিল।
গরুটা হেসে বলল, তবে আর কি, চলে যা সোজা নদীর পাড়ে। কাঁঠাল গাছ। মনে রাখিস।
অনেক ধন্যবাদ–একথা বলেই তিনু লাফাতে লাফাতে চলল নদীর পানে।
ইতিমধ্যেই হালকা বৃষ্টি শুরু হল। ঝিরিঝিরি বৃষ্টিতে ভিজে গেল গাছপালা, মাঠঘাট। তিনুও খানিক ভিজল।
নদীর কাছে গিয়ে তিনু তো অবাক। এখানে অনেক বড় বড় গাছ আছে। ঝাঁকড়া পাতার বিশাল মাথাওয়ালা সব গাছ। এদের মধ্যে কোনটা যে কাঁঠাল গাছ কে জানে? সে খুঁজতে লাগল।
বেশ কিছুদিন আগেই সে মাকে কাঁঠাল পাতা খেতে দেখেছিল। তখনও তার ঘাস-পাতা খাওয়ার বয়স হয়নি বলে সে খেতে পারেনি। একবার খালি কৌতুহলবশত আধো-বুলিতে জিজ্ঞেস করেছিল, ওতা কী পাতা গো মা?
মা চোখ বুজে আমেজ করে চিবোতে চিবোতেই গম্ভীর ভাবে বলেছিল, কাঁঠালপাতা।
সেই থেকে পাতাটার কথা মনে আছে তার। সেদিনের ছবিটা যেন আজও তার চোখে ভাসছে। সেই ছবি মনে করেই খুঁজতে লাগল কাঁঠাল গাছ। সবুজ রঙের চ্যাপ্টা পাতাগুলো রোদের আলোয় খুব চকচক করছিল।
হ্যাঁ পেয়েও গেল। এইতো বৃষ্টি-ভেজা পাতাগুলোর ওপর রোদ পড়লে চিকচিক করে উঠছে। এটাই তাহলে কাঁঠাল গাছ। পাতা খেতেও অনেক সুবিধা হবে। ডালগুলো অনেক নিচে ঝুলে রয়েছে। ভারি আনন্দ হলো তার। মা দেখে খুব খুশি হবে।
পাতাসহ গাছের অনেক ডাল জোগাড় করল সে। কেননা শুধু পাতা নিতে হলে মুখে করে অনেকটা পাতাই নেওয়া যাবে। কিন্তু পাতাসমেত ডাল থাকলে বাসায় নিয়ে যেতে সুবিধা হবে। একসঙ্গে অনেক পাতা নেওয়া যাবে।
পাতাসহ গাছের ডালগুলো সে পিঠে চাপিয়ে বাসায় ফিরল। আসার সময় দেখে এক্কা আর দোক্কা পেট ভরে কচি ঘাস খেয়ে ওখানেই ঘুমাচ্ছে।
বাসায় ফিরে এসে ডাল-পাতাগুলো পিঠ থেকে নামিয়ে রেখে লাফাতে লাফাতে মাকে ডাকল, মা মা, দেখে যাও কাঁঠাল পাতা এনেছি।
ভেবেছিল মা এসে দেখে খুশি হবে। তার প্রশংসা করবে। কিন্তু মা এসে দেখেই রেগে গেল। বলল, এ তুই কী এনেছিস?
কেন? কাঁঠাল পাতা–অবাক হয়ে বলল তিনু ।
সে বুঝতে পারল না এতে রাগ করার কী আছে? মা বলল, কাঁঠাল পাতা? এ কাঁঠাল পাতা? এ তো বটপাতা। তুই কাঁঠাল পাতা চিনিস না তো আনতে গেলি কেন? এক্কা আর দোক্কা কোথায়?
ওরা সামনের মাঠে কচি ঘাস খেয়ে ওখানেই ঘুমিয়ে পড়েছে।
তিনুর খেয়াল হলো নদীর পারে যে অন্যরকম দুটো গাছ আছে সেগুলোই তবে কাঁঠাল গাছ। ভেজা পাতায় রোদ পড়ে চিকচিক করছিল বলে বট পাতাকে সে কাঁঠাল পাতা ভেবে বসেছে।
ছাগু ঝাঁঝিয়ে উঠে বলল, সত্যি তিনু, তোকে নিয়ে আর পারা যায় না। তুই একটা না একটা ভন্ডুল করবিই করবি। তুই নিজে খেয়েছিস এই পাতা?
তিনু অপরাধীর মতন মাথা নিচু করে বলল, না মা।
কেন?
তোমারও তো কিছু খাওয়া হয়নি মা, একইভাবে বলল তিনু, আমরা খাবার আনলে তবে তো তুমি খাবে বলেছিলে। আমি ওখানে খেতে গেলে তোমার খেতে দেরি হয়ে যেত। তাই ভাবলাম আমরা একসঙ্গে খাব। কিন্তু আমি তো জানি না, তাই…!
তিনুর কথা শুনে ছাগু বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেল। ছেলেটা মায়ের কথা ভেবে নিজে না খেয়ে খাবার নিয়ে এসেছে! আর বাকী দুটো নিজেরা খেয়েদেয়ে দিব্যি ঘুমোচ্ছে। বলল, তার মানে তুই এত বেলা পর্যন্ত না খেয়ে রয়েছিস?
তিনু মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানায়।
ছাগুর চোখ থেকে জল বেরিয়ে এল। ছেলের মাথায় হাত রেখে হাসিমুখে বলল, চল আমরা কাঁঠাল পাতা খেয়ে আসি।
দুজনে বেরিয়ে পড়লো।
পাঠকদের মন্তব্য
250