দেশ জোড়ার আঠা
রামরমণ ভট্টাচার্য
(শ্রদ্ধায় স্মরণে )
ছোটোকাকা শিগগির এসো পশ্চিমবঙ্গ পাওয়া যাচ্ছে না…! ছোটোকাকা তোমার পশ্চিমবঙ্গ চুরি হয়ে গেছে…! সুদীপ্ত ছবি আঁকছিল। চারদিকে রঙের পাত্র, তুলি, নানা ছবি ছড়ানো-ছেটানো। তার মধ্যে বন্যার জলের মতো প্রবেশ করল ওরা ছয়জন। ওরা মানে তিতু, মিতু, নন্তু, রবি, টুবলু, টিনু। ছয় জ্যাঠতুতো, খুড়তুতো, পিসতুতো ভাইবোন–সবার বয়েস আট থেকে দশ। সুদীপ্ত ধমক দিয়ে বলল, চুপ কর। একসঙ্গে একজনের বেশি কথা বলবি না–উঃ এমন চমকে দিয়েছিস সব, একটু হলে হাসপাতালে নিয়ে যেতে হত মামাকে I তপসে বল।
রবিকে সুদীপ্ত তপসে বলে ডাকে, রবি বলে ফেলুমামা। ওরা নানা ধরনের গোয়েন্দাগিরি করে কলকাতায় এলেI স্মৃতিকণার দুই মেয়ে তিন ছেলে। তিন ছেলেই থাকে বাংলার বাইরে–ব্যাঙ্গালোর, গুজরাত আর দিল্লিতে। ওখানে দুর্গাপূজার ছুটি এক-আধদিন। তবু অন্তত সাতদিনের ছুটি নিয়ে সবাই আসে মায়ের কাছে I স্মৃতিকণার স্বামীর মৃত্যুর পর থেকে এই রীতি চলছে I সুদীপ্ত পিতৃমাতৃহীন। স্মৃতিকণার দেওরের ছেলে I দু’বছর বয়স থেকে স্মৃতিকণার কাছে আছে।
অনেকে আবার একসঙ্গে কথা বলতে যাচ্ছিল I সুদীপ্তর ধমক খেয়ে রবি ওরফে তপসে বলল, তুমি যে ভারতবর্ষের ম্যাপটা দিয়েছিলে তার মধ্যে পশ্চিমবঙ্গটা পাওয়া যাচ্ছে না।
কখন থেকে পাওয়া যাচ্ছে না?
একসঙ্গে সকলে কলবল করে উঠতেই আবার সুদীপ্তর ধমক, বলেছি না একজন কথা বললে, অন্যরা চুপ করে থাকবি–মিতু তুমি বলো।
আজ সকাল থেকে I মানে এখন থেকে। আমরা সবাই খুঁজেছি। কোথাও পাচ্ছি না।
গতকালই সুদীপ্ত ওদের আঠাশটা রবারের টুকরো দিয়ে তৈরি একটা ম্যাপ উপহার দিয়েছে। নানা রঙের টুকরোগুলো আসলে এক-একটা প্রদেশ I খাঁজে খাঁজে লাগিয়ে দিলে ভারতবর্ষ হয়। পাশে পাশে প্রতিবেশী দেশ নেপাল, ভূটান, বাংলাদেশ, পাকিস্তান এবং শ্রীলংকা I ওগুলোর রং সাদা। একটা ছোটো কাঁটা দিয়ে এগুলো ম্যাপ থেকে তুলেও ফেলা যায়। ম্যাপটা দেবার পর সুদীপ্ত বলেছিল ঠিক দুদিন পর আমি সকলের পরীক্ষা নেব–কোন প্রদেশ ভারতের কোথায় ? একেবারে তুলতে হবে। যে প্রথম হবে, তাকে একটা নতুন উপহার দেওয়া হবে। তিতু প্রশ্ন করেছিল যদি দুজন প্রথম হয়? সুদীপ্ত বলেছিল–সবাই প্রথম হলে সবাইকেই দেওয়া হবে।
গোটা দলটার দিকে একবার চোখ বুলিয়ে নিয়ে সুদীপ্ত জিজ্ঞাসা করল–পশ্চিমবঙ্গ নেই এটা কে প্রথম জানতে পেরেছে?
আমি–আমি প্রথম বলেছি। টুবলুর স্বরে বেশ একটা গর্ববোধ ফুটে উঠল। টুবলুকে সমর্থন করল সকলে, আমরা সবাই খুঁজেছি, পাইনি।
না–তোমরা সবাই খোঁজনি। অন্তত একজন তো বটেই। সুদীপ্ত ক্যানভাসের ওপর মোটা রঙের তুলির টানের মতো সকলের মুখে চোখ বুলিয়ে স্থির হলো রবির মুখে, তপসে বলো তো কে সে? আজ তোমার পরীক্ষা!
মৌলি ! –রবির মুখ থেকে মৌলি শব্দটা পুরো উচ্চারণ হবার আগেই ছয়জন একসঙ্গে তুবড়ির মতো সরব হয়ে উঠল, মৌলি, মৌলি তো আজ খেলেনি। কোথায় গেল মৌলি ?
মৌলি সবার ছোটো। রবির ছোটো বোন। একমাস আগে তার চার বছর পূর্ণ হয়েছে। মৌলি কেন খেলতে আসেনি! কোথায় মৌলি! মৌলি আজ ঠামের ঘরে।
দল বেঁধে ঝটিকাবাহিনীর মতো সকলে দৌড়োলো দোতলায় স্মৃতিকণার ঘরে। আর সঙ্গে সঙ্গে মৌলি দৌড়ে গিয়ে আশ্রয় নিল তার দিদার কোলে। মুহূর্তে একবার দৃষ্টি বিনিময় হয়ে গেল মামা-ভাগ্নের মধ্যে। রবি বলল, অ্যালিবাই অত্যন্ত দুর্বল।
শব্দটা রবি শিখেছে তার ফেলুমামার কাছ থেকেই I ও এবার ফাইভে উঠেছে। সুদীপ্তর চোখের ইঙ্গিত পেয়ে বলল–মৌলি! পশ্চিমবঙ্গ কোথায়?
পশ্চিমবঙ্গ হারাবার রহস্য যে মৌলিই সমাধান করতে পারে সেটা তার মুখ দেখেই বোঝা গেল। কিন্তু কোনো উত্তর না দিয়ে সে তার দিদার কানে কানে কী যেন বলল। দিদা সকলকে দূরে সরে যেতে বলে মৌলির কানে কানে কি বলল ! তারপর আবার মৌলি! দুজনের কানাকানি যেন আর শেষ হয় না।
আসলে এই কানাকানির ছোট্ট একটু ইতিহাস আছে। সুদীপ্ত ভারতবর্ষের মানচিত্রটা দিয়ে সাতজনকে বুঝিয়েছিল একই সঙ্গে ভারতবর্ষের একতা ও ভিন্নতা। পিন দিয়ে অন্ধ্র প্রদেশটা তুলে ধরে জিজ্ঞাসা করেছিল–এটা কি বল তো? উত্তরে সবাই বলেছিল একটা ট্যারা-বাঁকা গর্ত। ঠিক তাই, সুদীপ্ত উৎসাহিত হয়ে বলেছিল, দেখ এই গর্তটা একমাত্র অন্ধ্র দিয়েই ভরাট করা যায়, আর কোনো কিছু দিয়ে নয়। ঠিক একই রকম পশ্চিমবঙ্গ কিংবা মণিপুর অথবা বিহার। এক থাকলে আমাদের কত বড় দেখায়, কিন্তু আলাদা হয়ে গেলে এই এতটুকু।
এইসব কথার পিঠেই কেউ, সম্ভবত মৌলির মা-ই বলেছিল, ম্যাপের মধ্যে দেশগুলোকে কত কাছাকাছি মনে হয়। কিন্তু ম্যাপের বাইরে বাস্তবে দুই দেশের মধ্যে কি বিরাট বাধা। মৌলির মা স্মৃতিকণার বড়ো মেয়ের এই ক্ষোভের আড়ালেও একটা ব্যথা আছে । স্মৃতিকণার জন্ম বর্তমান বাংলাদেশে। ছেচল্লিশের দাঙ্গার সময় পালিয়ে এসেছিল কিশোরী বয়সে। তারপর আর জন্মভূমি দেখা হয়নি। এখন ছেলেমেয়েরা প্রতিষ্ঠিত–তাই বড়ো সাধ খুলনার জন্মভিটে একবার স্পর্শ করে আসবে। কিন্তু নানা বাধায় ভিসা পাওয়া যাচ্ছে না। অথচ কতটুকুই বা পথ।
রাতে মৌলি তার দিদার বুকের সঙ্গে লেপটে শুয়ে প্রশ্ন করেছিল, দিদা তোমার বাড়িতে কে আছে?
স্মৃতিকণা আরো কাছে টেনে নিয়ে বলেছিল–কেউ নেই, আবার সব আছে–অনেক কথা, অনেক মুখ, অনেক সুখ–সব ঘুমিয়ে আছে অভিশপ্ত রাজকন্যার মতো। একবার ছুঁলেই জেগে উঠবে সকলে, সবকিছ। তুমি বড় হও, তখন সব বুঝবে।
তবু মৌলি জিজ্ঞাসা করেছিল, আমি তো দিল্লি থেকে চলে এলাম। তোমার বাড়ি কি তার চেয়ে দূর ?
না তার চেয়ে অনেক কাছে, কিন্তু ওটা আলাদা দেশ। দেখলে না ভারতের সঙ্গে জোড়া লাগানো নেই।
হঠাৎ মৌলিকে বুকে তুলে নিয়ে হু-হু করে কেঁদে উঠল স্মৃতিকণা। সকলে কেমন হতভম্ব হয়ে গেল। স্মৃতিকণা চোখ মুছে বলল, শোন সুদীপ্ত, আমার দিদিভাইয়ের কথা। তুই বাংলাদেশকে আলাদা রেখেছিস কেন? মৌলি দুটোই নিয়েছে। ও ড্রেনড্রাইট দিয়ে দুটো দেশকে জোড়া লাগিয়ে আমার নারায়ণ শিলার পিছনে রেখে দিয়েছে। মিতু বলল, ঠাম আমি নিয়ে আসব?
যা নিয়ে আয়–কথা শেষ হবার আগে মিতুর পিছনে সকলে ছুটল।
আঠাটা একটু আগেই বোধহয় লাগানো হয়েছে। এখনো শুকোয়নি। পশ্চিমবঙ্গ ধরে তুলতে গিয়ে বাংলাদেশেটা পড়ে গেল মেঝেয়।
স্মৃতিকণা মৌলিকে আদর করে বলল, ঠিক করেছ দিদিভাই, খুব ভালো করেছI তারপর সকলের দিকে তাকিয়ে বলল, বড় হয়ে তোমরা এমন একটা আঠা আবিষ্কার করবে, যা দিয়ে জোড়া লাগালে কোনো দেশ আর ভাঙবে না।
পাঠকদের মন্তব্য
250