তিস্তাপারের বস্তিতে
নীতীশ বসু
আশ্বিন মাস। আর ক’দিন পরেই তো দুগ্গা পুজো I তুতুন, তোয়া, পিন্টু আর বিল্টুরা সরকারি স্কুলে ক্লাস সিক্স-এ পড়ে, ওদের বাড়িও তো তিস্তানদীর পারে। ওদের কারও বাবা জলপাইগুড়ি শহরে রিকশা চালায়, কেউ রাজমিস্ত্রির কাজ করে, কেউ টোটো ভাড়ায় চালায়, কেউ আবার কারো দোকানে কাজ করে। সবাই দিনের শেষে যে যার ঘরে ফেরে। ওদের মায়েরা ঘরে বসে রান্নাবান্না করা ছাড়াও ওদের মধ্যে কেউ ছাগল পোষে, কেউ হাঁস মুরগি পোষে, কেউ আবার গরু পোষে। এতে ওদের অনেক আয় হয়। ওদের সবার ইচ্ছে এবার তিস্তাপারে ওরা দুগ্গা পুজো করবে। এ খবর শুনে তোয়া, তুতুন, বিল্টু, পিন্টুরাও খুব খুশি হয়।
তোয়া, তুতুন, বিল্টু, পিন্টুরা একসঙ্গে স্কুলে যায় আবার একসঙ্গে বাড়ি ফেরে। আজ ওদের স্কুল কি কারণে ছুটি দিয়েছে ওরা জানে না। বিল্টু বলল, চল তিস্তানদীর পারে কাশফুলের কী সুন্দর ঢেউ খেলছে দেখে আসি। বাড়িতে তো উঠোন জুড়ে শিউলি ফুলের হাট। তোয়া বলল তাই চল। ওরা সবাই কাশফুলের ঢেউ দেখতে দেখতে হঠাৎ তুতুন চিৎকার করে বলে উঠল, ওই দেখ কাশবনের আড়ালে একটা শেয়ালের মত জন্তু ছাগলটাকে কীভাবে লক্ষ্য করে আছে, যখন তখন ছাগলটাকে ধরবে। এমন সময় তোয়া বলল, আরে ওই ছাগলটা তো আমাদের, এখন কি হবে? বিল্টু বলল, তোরা নদীতে মাছ ধরছে জেলে কাকুদের কাছে গিয়ে বল, এদিকে আমি আর পিন্টু ওর একটা ব্যবস্থা করছি।
তোয়া তুতুন তো ছুটে গিয়ে হাঁফাতে হাঁফাতে বলল, কাকু কাকু, ওই কাশবনের আড়ালে শেয়ালের মতো দেখতে একটা জন্তু আমাদের ছাগলটাকে ধরবে বলে তাক করে আছে। তোমরা শিগগিরি চল। তা না হলে ছাগলটাকে মেরে ফেলবে।
জেলেরাও তাদের জাল নিয়ে ওদের পিছন পিছন ছুটে এলো। জেলেরা ছুটে এসে বলল, কোথায় শেয়াল? বিল্টু বলল, ওই কাশবনের ভেতরে।
জেলেদের একজন লক্ষ্য করে বলল, ওই তো কাশবন নড়ছে। ও ওখানেই আছে, দাঁড়াও আমরা ওকে জাল দিয়ে ধরছি।
যেমনি ভাবা তেমনি কাজ। জাল ফেলতেই চমকে উঠে একজন জেলে বলল, সে কি এ তো শেয়াল নয়! এ তো চিতা বাঘ। ওরা জাল ফেলে দৌড়ে বাঁধের ওপর উঠে বলতে লাগল, চিতাবাঘ,চিতাবাঘ,পালাও পালাও। ওদের চিৎকারে বাঁধের ওপর অনেক মানুষের ভিড় হয়ে গেল, কেউ বলছে সরে যাও। কেউ বলছে বনদপ্তরকে ফোন করো। ওদের মধ্যে কেউ একজন বনদপ্তরে ফোন করে সব জানিয়ে বলল, আপনারা শিগগির আসুন।
বনদপ্তরের লোকজন এসে চিতা বাঘটাকে ধরে নিয়ে গেল। এদিকে তোয়া, তুতুন, বিল্টু, পিন্টুদের মা-বাবারা খবর পেয়ে ছুটে এসেছে। ছেলে-মেয়েদের হাত ধরে বাড়ি যেতে যেতে বলল, আর তিস্তানদীর পারে যাস না। এখন জঙ্গল থেকে বাঘ, চিতাবাঘ, হাতি এসব লোকালয়ে বেরিয়ে আসছে। ওরাও ভয় পেয়ে কোন কথা না বলে মা-বাবার সঙ্গে যে যার বাড়িতে চলে গেল।
পরের দিন স্কুলে যাওয়ার সময় ভালো করে এদিক ওদিক তাকিয়ে স্কুলে গিয়ে স্যারকে সব কথা বলল। ওদের কথা শুনে স্যারেরা বললেন, তোমরা সাবধানে আসা-যাওয়া করো। স্যারের রুম থেকে বেরিয়ে এসে পিন্টু বলল, ভাগ্যিস জেলে কাকুরা সময় মতো এসে পড়েছিল, না হলে আমরা যে ভাবে ঢিল ছুঁড়ছিলাম তাতে চিতা বাঘটা আমাদের দিকে যদি ছুটে আসত, তাহলে কি হতো ?
এমন সময় বিল্টু বলল, এবারের মতো বেঁচে গেছি। তোয়া বলল, আমাদের দুগ্গাপুজোর কি হতো?
বিল্টু বলল, দুগ্গামায়ের পুজো ঠিকই হবে।
সবাই ওর কথা শুনে হাসতে হাসতে ক্লাসে ঢুকে জানালার পাশে দাঁড়িয়ে কাশবনের দিকে তাকিয়ে মনে মনে ভাবতে লাগল, গতকাল কি অবস্থাই না হয়েছিল।
সত্যিই তিস্তাপারের বস্তিতে দুগ্গাপুজো খুব ধুমধাম করে হয়ে গেল, সবার খুব আনন্দ হয়েছিল। দুগ্গামায়ের বিসর্জন দিয়ে বিল্টু বন্ধুদের বলল, সামনের বছর আবার দুগ্গাপুজোও হবে, আর এবার থেকে প্রতি বছর গাছও লাগাতে হবে। তাহলে চিতা বাঘ, হাতি, শেয়ালেরা থাকবে ওই বনের ভেতর, লোকালয়ে বেরিয়ে আসবে না। কেন আমাদের বিজ্ঞান স্যার কি বলেছিলেন?
স্যার বলেছিলেন, প্রতিটা মানুষের গড়ে এক দিনের জন্য তিন সিলিন্ডার অক্সিজেন লাগে। কিন্তু একটা বড় গাছ একাই হাজার হাজার মানুষের অক্সিজেন দিতে পারে, তাহলে?
বিল্টুর কথাই সবাই একসঙ্গে বলে উঠল হ্যাঁ, হ্যাঁ, আমরা সবাই গাছ লাগাব।
তুতুন বলল, এত গাছের চারা কোথায় পাবি? বিল্টু হাসতে হাসতে বলল, সে নিয়ে ভাবতে হবে না। ওরা বিল্টুর কথা শুনে বলল, তুই ঠিক বলেছিস। তাহলে আজ থেকে শুরু করে দেই।
বিল্টু বলল, আগে বনদপ্তরের সঙ্গে কথা বলি, তারপর। সবাই বিল্টুর কথা শুনে মনের আনন্দে যে যার বাড়ির দিকে রওনা দিল।
পাঠকদের মন্তব্য
250