সোনালির বন্ধু শিউলি
শিবশঙ্কর দাস
কদিন যাবৎ সোনালির মনটা খুব খারাপ। বন্ধু শিউলিকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। কোথাও পালিয়ে গেল, নাকি কেউ মেরে ফেলল, সেই নিয়েই চিন্তা। সন্দেহটা গিয়ে পড়েছে বাড়ির পোষা বিড়াল মেনির ওপর। অনেকদিন ধরেই মেনির লোভ ছিল শিউলির ওপর, কিন্তু ধরতে পারেনি। এরমধ্যে ধরে ফেলেছে কিনা কে জানে! সোনালির খেতে ভালো লাগছে না, শুতে ভালো লাগছে না, পড়তে ভালো লাগছে না, স্কুলে গিয়েও ভালো লাগছে না। যে ঘরে-বাইরে সারাক্ষণ তার সঙ্গী হয়ে থাকতো, তাকে হারালে মন খারাপ হওয়াটাই স্বাভাবিক। দু-একবার চোখের জল ফেলেছে সোনালি। মা মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলেছে, “কেঁদে আর কী করবি ? যদি বেঁচে থাকে দেখবি ও আবার ফিরে আসবে তোর কাছে। ওর জন্য মন খারাপ করে খাওয়া-দাওয়া বন্ধ করে দিলে, তুইও তো বাঁচবি না। তার চাইতে পেট ভরে খেয়ে শরীর মন সুস্থ রাখ। মন দিয়ে পড়াশোনা কর। আমি বলছি তো ও ফিরে আসবে তোর কাছে।”
মার কথায় শিউলির মন ভালো হয়ে গেলেও বেশিক্ষণ ভালো থাকে না। ঘুরে ফিরে আবার সেই বন্ধু শিউলির কথাই মনে পড়ে।
এই তো গত বছর সোনালির মা শিউলিকে কুড়িয়ে পেয়েছিল উঠোনের শিউলি গাছটার নিচে। ওদের বাড়িতে একটা শিউলিগাছ আছে। সেই গাছে একজোড়া ভাত শালিকের বাসা ছিল। সেই বাসায় দুটো বাচ্চাও হয়েছিল। একদিন রাতে ঝড়ে বাসা ভেঙে মাটিতে পড়ে যায়। বাসার সঙ্গে বাচ্চাদুটোও পড়ে যায়। সকালবেলা সোনালির মা ঘুম থেকে উঠে শালিকের ভাঙা বাসাটা দেখতে পায়। বাসা সরিয়ে উঠোন পরিষ্কার করতে গেলে বাচ্চাদুটো বেরিয়ে পড়ে। তখনও একটা বাচ্চা বেঁচে ছিল। জীবিত বাচ্চাটাকে ঘরে এনে সোনালি এবং তার মা মিলে লালন-পালন করে।
সোনালি ক্লাস টু-এ পড়ে। পাখির বাচ্চা পেয়ে, সে তো ভীষণ খুশি। শিউলিগাছ থেকে পড়েছে বলে সোনালি ওর নাম দিয়েছে শিউলি। ভাত-মুড়ি এসবের পাশাপাশি জঙ্গল থেকে পোকামাকড় ধরে এনেও বাচ্চাটিকে খাইয়েছে সে। দেখতে দেখতে বাচ্চাটা বড় হয়ে গেল। প্রথমদিকে শিউলি একটা খাঁচার মধ্যে বন্দি থাকতো। কিন্তু বড় হবার পর ওকে খাঁচা থেকে ছেড়ে দেওয়া হয়। ছেড়ে দেওয়া হলেও শিউলি কোথাও যায় না। ওই বাড়িতেই থাকে। রাতে শিউলি গাছের ডালে রাত কাটাতো।
সোনালি স্কুলে গেলে ওর কাঁধে চড়ে শিউলি স্কুলে চলে যেত। স্কুল ছুটি হলে আবার শিউলি কাঁধে চড়ে বাড়ি ফিরে আসত। ক্লাসে বসে সোনালির সঙ্গে মিড-ডে মিলের খাবার খেত। অন্য সময় স্কুলের ভেতরে মেহগনি গাছের ডালে বসে থাকত শিউলি। কখনও কখনও ক্লাসে সোনালির পাশে বেঞ্চিতেও বসে থাকত শিউলি। এভাবে সোনালির অন্য বন্ধুদের সঙ্গেও শিউলির খুব ভাব হয়ে গেছিলো। এমনকি মাস্টারমশাই, দিদিমণিরাও শিউলিকে ভালবাসতেন। শিউলিকে ক্লাসে দেখে তারা কিছু বলতেন না। বরং তারাও শিউলির জন্য খাবার এনে দিতেন। সোনালি একটু একটু করে শিউলিকে কথা বলতে শিখিয়েছিল। শিউলি মানুষের মতো কথা বলতেও শিখে গেছিল। সে সোনালির নাম ধরে ডাকতো। বলতো, ‘এই সোনালি’। শিউলির মুখে কথা শুনে সবাই বেশ মজা পেত।
সেই শিউলির পাত্তা নেই আজ সাত দিন হয়ে গেল। সোনালি শিউলির কথা মনে করে আর কষ্ট পেতে চায় না। দুপুরে বেঞ্চিতে বসে বন্ধুদের সঙ্গে মিড ডে মিলের খাবার খাচ্ছে ঠিক সেই সময়ই কে যেন বলে উঠলো, ‘এই সোনালি’। শুনেই সোনালি খাওয়া ফেলে বাইরে ছুটে এলো, সঙ্গে অন্য বন্ধুরাও। এসে দেখে শিউলি কার্নিশে বসে আছে। সঙ্গে আর একটা শালিক। সোনালির ভীষণ আনন্দ হলো। সোনালি ডাক দিতেই শিউলি উড়ে এসে সোনালির হাতে বসলো। কিন্তু অন্য শালিকটি এলো না। সোনালি ওকে হাতে করে ভেতরে নিয়ে যেতে চাইলে শিউলি উড়ে গিয়ে আবার কার্নিশে বসলো। সোনালি ওদের জন্য বাইরে এসে খাবার দিল। ওরা দুজনেই খাবার খেল। তারপর কোথায় যেন উড়ে চলে গেল। সোনালির মনটা আবার খারাপ হয়ে গেল।
বাড়ি ফিরে মাকে বলল, “জানো মা শিউলি ওর একটা বন্ধুকে নিয়ে আজ স্কুলে এসেছিল। তারপর কোথায় যেন উড়ে গেল। আচ্ছা মা, শিউলি উড়ে গেল কেন? আমাদের বাড়ি এলো না কেন আর?”
মা বলল, “ মানুষ তো ওদের বন্ধু নয়। ওর এখন একটা পাখিবন্ধুই চাই। সেই বন্ধুকে নিয়ে এবার ও বাসা বাঁধবে। ওদেরও ফুটফুটে বাচ্চা হবে। সেজন্যই ও আর এলো না।”
“আসতে তো পারতো। আমাদের শিউলি গাছেই আবার ওরা বাসা বানাতো। তাহলে ভালো হতো না!”
“তাহলে তোমার হয়তো ভালো লাগতো। কিন্তু, ওর নতুন বন্ধু তো এখানে থাকতে ভয় পেত। সেইজন্যই ওরা নিরিবিলি জায়গায় চলে গেল।”
মার কথা শুনে মন খারাপ সেরে গেল সোনালির । মনে মনে বলল, ‘পাখিবন্ধুকে নিয়ে ভালো থেকো শিউলি’।
পাঠকদের মন্তব্য
250