ছোটোদের চাঁদের হাসি / গল্প শুধু গল্প নয় / নভেম্বর ২০২৩

কালের সাক্ষী খোশবাগ

ওই, ওই যে পাঁচিলটা দেখছেন, ওর গা ঘেঁষেই ছিল লুৎফান্নিসা বেগমের ঘর। জীবনের শেষ ক'টা দিন ওখানেই কাটিয়েছেন তিনি। স্বামী-সন্তান সব হারিয়ে একাকিনী এক নারী, চারপাশে সমাধির নিচে শুয়ে তাঁর আপন ও পরিচিতজনেরা। গাইড বলে চলছিলেন–শুনতে শুনতে যেন পৌঁছে যাচ্ছিলাম ইতিহাসের সেই সময়ে। সময়ের সেই পাতায় লেখা হয়েছে হত্যা, ষড়যন্ত্র, বিশ্বাসঘাতকতা, রক্তপাত এবং কিছু মানুষের অবর্ণনীয় যন্ত্রণার ইতিহাস।

দাঁড়িয়ে আছি খোশবাগের অভ্যন্তরে। আকাশের রঙ ধূসর। তারও বুকে যেন জমা কতকালের ভেজা ব্যাথার মেঘ–এখনই কান্না হয়ে ঝরবে, যেমন, ঝরেছিল সেই দিনটিতে। ১৭৫৭ সালের ২৩শে জুন–পলাশীর যুদ্ধে ইংরেজদের সঙ্গে যুদ্ধে হেরে গেলেন সিরাজ, তাঁরই সেনাপতি মীর জাফরের বিশ্বাসঘাতকতায়। রবার্ট ক্লাইভের নেতৃত্বে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বাংলার সিংহাসন দখল করল। বাংলার পথ ধরে সমগ্র উপমহাদেশ। তারপর ২০০ বছরের পরাধীনতার ইতিহাস ! ১৭৫৭-র ২রা জুলাই সিরাজকে মেরে ফেলে ইংরেজরা। সেদিন থেকে তাঁর নশ্বর দেহ এখানেই শায়িত। সিরাজ ছাড়াও খোশবাগে রয়েছে তাঁর দাদু আলীবর্দী খাঁয়ের সমাধি। আছে সিরাজের মা আমিনা বেগম, অন্যতম ষড়যন্ত্রকারী মাসি ঘসেটি বেগম, স্ত্রী লুৎফা-সহ পরিবারের অন্যান্যদের সমাধি।

খোশবাগ ছিল নবাব আলীবর্দী খাঁয়ের সখের গোলাপের বাগান। গোলাপের খুশবু থেকেই  খোশবাগ নামকরণ। গঙ্গা এখানে হুগলি নদী নামে পরিচিত। তারই এক তীরে নবাবের প্রাসাদ ও অন্যান্য ভবন। বিপরীত তীরে খোশবাগ। অবকাশ পেলেই পরিবারের লোকজনকে নিয়ে আনন্দ যাপনে এখানে চলে আসতেন আলীবর্দী। সেই খোশবাগ পরে পরিণত হলো নবাবের পারিবারিক সমাধিস্থলে। কালের নিয়মে হুগলি এখন খোশবাগ থেকে অনেকটা দূরে সরে গিয়েছে। পারাপার অবশ্য আজও চালু রয়েছে।

খোশবাগের পরিবেশটা ভারি সুন্দর। ঘন সবুজের গালিচা পাতা বাইরের সবটুকু জুড়ে। উঁচু পাঁচিল ঘেরা বাগানের ভিতরে প্রাচীন গাছেরা দাঁড়িয়ে। আছে বাহারি ফুলের বাগান। ভারতীয় পুরাতত্ত্ব সর্বেক্ষণ এর রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব নেওয়ার পর খোশবাগের অন্দর ও বহিরঙ্গ যথাযথ যত্ন পাচ্ছে বলা যায়। আলীবর্দী খাঁয়ের আদরের নাতি সিরাজের জন্ম ১৭৩৩ সালে। মসনদে মাত্র একটি বছর বসার সুযোগ পান তিনি–১৭৫৬ থেকে ১৭৫৭। গাইডের কাছে শুনছিলাম, সিরাজকে সর্বসমক্ষে কতখানি নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছিল। তারপর সিরাজ ও লুৎফার কন্যার ভাগ্যেও একই দশা ঘটে।

এত কিছুর পরও কয়েক বছর বেঁচেছিলেন লুৎফা। প্রতি সন্ধ্যায় মোম আর আগরবাতি জ্বালাতেন সিরাজের সমাধিতে। ইংরেজ সরকার তাঁর অনুরোধে এটুকু অনুমতি দিয়েছিল। এছাড়া সমগ্র খোশবাগের দেখভালের দায়িত্বও নেন লুৎফা। এ কাজের জন্য যে মাসোহারা পেতেন, তাতেই তাঁর জীবিকানির্বাহ হতো। ১৭৯০ সালে মৃত্যু হয় লুৎফার। জনহীন খোশবাগে দাঁড়িয়ে কান পাতলে আজও শুনতে পাবেন কালের কলধ্বনি। শুধু বাঙালি নয়, সমগ্র ভারতবাসীর অন্তত একবার এসে দাঁড়ানো উচিত মুর্শিদাবাদ জেলার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক কেন্দ্র খোশবাগে।

                                                         ছবি : লেখক


পাঠকদের মন্তব্য

কোন মন্তব্য পাওয়া যায়নি

আপনি কি এই লেখায় আপনার মন্তব্য দিতে চান? তাহলে নিচে প্রদেয় ফর্মটিতে আপনার নাম, ই-মেইল ও আপনার মন্তব্য লিখে আমাদের পাঠিয়ে দিন।
নাম
ই-মেইল
মন্তব্য

250

    keyboard_arrow_up