ছিল খাদ হলো পথ
অশোককুমার মিত্র
পর্ব : ২
আগের পর্বেই বলেছি, বড়িষার সাবর্ণ রায়চৌধুরী লক্ষ্মীকান্তর বংশধর রামচাঁদ রায় মনোহর দিগরের কাছ থেকে মাত্র ১৩০০ (তের শত টাকা) টাকায় সুতানুটি, কলকাতা ও গোবিন্দপুর–এই তিন মৌজার জমিদারি কিনে ফেললেন৷ পাকাপাকিভাবে ঠিকানা তো হলো, এবারে চাই জাঁকিয়ে ব্যবসা। তাহলে, এদেশে বসতও গড়তে হয়। লালদীঘি ঘিরে কিছু বাড়ি ছিল বটে, এবারে চলল বন কেটে, ডাঙা জমি জুড়ে বসত গড়ে তোলা। বিদেশ থেকে আরও কর্মী এলো, ব্যবসা বাণিজ্যে তাদের মদত দিতে। নিজেদের আখের গোছাতে অনেক এদেশি মানুষও সুতানুটি-কলকাতা-গোবিন্দপুর এই তিন গাঁয়ে বা তার গায়ে গায়ে বসতি গড়ে তুলল। সব মিলে কলকাতা ক্রমে হল জমজমাট। অবশ্যি, সাহেব-সুবোরা নিজেদের কৌলিন্য বজায় রাখতে দিশি মানুষদের তাঁদের কাছে ভিড়তে দেননি, দু’একটি ব্যতিক্রম ছাড়া।
ইতিমধ্যে দিল্লির বাদশাহ বদলেছে, বদলেছে বাংলার নবাবও। এমন কী রাজ্যের রাজধানীও ঢাকা থেকে তুলে মুর্শিদাবাদে আনা হয়েছে। সেসময় বাংলার বহমান শান্ত জীবনে এক ভয়ানক উপদ্রব এসে হাজির হলো–নাম তার বর্গি। বর্গিদের কথা বলতে গেলে শিবাজির কথা বলতে হয়। তাঁর নেতৃত্বে পশ্চিম ভারতে মারাঠা শক্তির আবির্ভাব ঘটে। সকল হিন্দুদের সংহত করে দিল্লির বাদশার বিরুদ্ধে তিনি প্রতিপক্ষ হয়ে ওঠেন। একদা শক্তিধর রাজপুত রাজারা মোগল বাদশাহদের বিরদ্ধে যুদ্ধ করেছেন হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের প্রতিভূ হয়ে। পরে যুদ্ধের পথে না গিয়ে শান্তিপূর্ণ সহ-অবস্থানের পথ ধরেছিলেন তাঁরা। তাই, এবারের লড়াইয়ে তাঁদের সহায়তা পেলেন না শিবাজি।
প্রসঙ্গত, জন্মসূত্রে শিবাজি কোনও রাজা-মহারাজার সন্তান ছিলেন না। তাঁর পিতৃদেব শাহজি ভোঁসলে ছিলেন বিজাপুরের সুলতানদের একজন মনসবদার। শিবাজির মা জিজাবাঈ থাকতেন পুনায়। বাবার কাছে বিজাপুরে না থেকে শিবাজি তাঁর মায়ের কাছে থাকতেন। সেখানে তিনি স্বাধীনভাবে মানুষ হয়েছিলেন। একটু বড় হতে তিনি নিজস্ব সেনাদল গড়ে, একের পর এক দুর্গ দখল করতে শুরু করলেন। ক্রমে তাঁর দলও বড় হল, রাজ্যেরও বিস্তার ঘটল। তাঁর আচমকা হানায় প্রতিপক্ষের অপ্রস্তুত সেনারা দলে ভারী হলেও হেরে ভূত হয়ে যেত।
পাহাড়ে তাদের চলাফেরা এত সহজ ও মসৃণ ছিল যে তাঁকে মোগলরা ‘পাহাড়ি ইঁদুর’ বলত। তা সত্ত্বেও একবার মোগলদের হাতে ধরা পড়ে শিবাজী আগ্রা দুর্গে আটক থাকেন। আশ্চর্য বুদ্ধিমত্তা ও কৌশলে তিনি দুর্গের কড়া প্রহরাকে ফাঁকি দিয়ে নিজেকে মুক্ত করে আত্মগোপন করে দেশে ফিরে আসেন। ততদিনে মারাঠা শক্তি দেশে প্রতিষ্ঠা লাভ করেছে। রায়পুরে শিবাজির রাজ্যাভিষেক হলো। শিবাজির পরাক্রমে বাদশাহ তাঁকে চৌথা দিতে রাজি হলেন। চৌথা মানে রাজস্বের চার ভাগের একভাগ। অবশ্য এমন কোনও নির্দেশনামা বাদশাহর কাছ থেকে কেউ পায়নি। বাংলাতেও কেউ তেমন দাবি করেনি, দেবার প্রশ্নও ওঠেনি।
শিবাজির মৃত্যুর পর ষাট বছর কেটে গেছে। মারাঠা রাজ্য তখন কতক আঞ্চলিক প্রধানের হাতে পড়েছে। নাগপুর অঞ্চলের প্রধান ছিলেন রঘুজি ভোঁসলে, আর তাঁর মন্ত্রী হলেন ভাস্কর রাও কোহলৎকার। তাঁর মাথায় নানা দুর্বৃদ্ধি খেলত। তাঁর বুদ্ধিতে রঘুজি আলিবর্দির কাছে চৌথা দাবি করলেন। কোনদিন এরাজ্যে এমন দাবি কেউ করেনি। আলিবর্দি এ রাজ্যের নবাব, তিনি সে দাবি মানলেন না। তখন কয়েক হাজার মারাঠি সেনা ছোট ছোট দ্রুতগতির ঘোড়ায় চেপে হঠাৎই কোনও সমৃদ্ধ গ্রাম বা জনপদে ঢুকে লুঠপাট করে, বাসিন্দাদের ওপর নৃশংস অত্যাচার করে বাড়িঘর জ্বালিয়ে অন্য লক্ষ্য–জনপদের দিকে ঘোড়া হাঁকাত। এমন আকস্মিক আক্রমণে অপ্রস্তুত বাসিন্দারা যথাসর্বস্ব হারাত। এমনকি একবার তারা মুর্শিদাবাদে জগৎ শেঠের বাড়ি লুঠ করে লক্ষ লক্ষ টাকার সোনা-রূপো, হিরে-জহরৎ পেয়েছিল।
বনজঙ্গল-নদী পেরিয়ে তাদের হানায় ক’বছরে বালেশ্বর, মেদিনীপুর, বর্ধমান, হুগলি ইত্যাদি অনেক গ্রাম ছারখার হয়ে গেল। তাদের অত্যাচারের কথা নিয়ে গ্রাম্য-কবি ছড়া গাঁথলেন–ছেলে ঘুমলো পাড়া জুড়লো বর্গি এল দেশে/ বুলবুলিতে ধান খেয়েছে খাজনা দেব কিসে? এই দিশেহারা অবস্থা থেকে প্রাণ বাঁচাতে বাধ্য হয়েই মেদিনীপুর-হুগলি-বর্ধমানের সম্পন্ন লোকেরা নতুন করে ঘর বাঁধার কথা ভাবতে শুরু করল। কলকাতায় কোম্পানি আছে, তাদের সেনাদল আছে, কামান-বন্দুক আছে–ওখানে গেলে নিশ্চয় এমন দুরাবস্থায় পড়তে হবে না। বর্গিদের তারা রুখে দেবে। তারা দল বেঁধে হাঁক দিল–চলো কলকাতা। ( চলবে )
পাঠকদের মন্তব্য
250