ছোটোদের চাঁদের হাসি / গল্প শুধু গল্প নয় / জুলাই ২০২৪

দেশের প্রথম পোস্ট অফিস

 

ভারতে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির একেবারে শুরুর দিক সেটা। পূর্ব মেদিনীপুরে অবস্থিত খেজুরি তখন একেবারে জঙ্গলাকীর্ণ এক অঞ্চল। বঙ্গোপসাগরের তীরবর্তী এই এলাকায় মগ আর পর্তুগিজ জলদস্যুদের মহা উৎপাত ! এরই পাশাপাশি বন্যপশুদের অবাধ বিচরণক্ষেত্র হওয়ায় লোকালয় গড়ে ওঠার অন্তরায় ছিল জায়গাটি। আবার অন্যদিকে বঙ্গোপসাগরের এই অংশটিতে জলের নাব্যতা যথাযথ মাত্রায় থাকার কারণে জাহাজ ভেড়াতে সুবিধা হতো। সবদিক বিবেচনা করে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি এই অঞ্চলের সুরক্ষা ও নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করা এবং তাকে ব্যবসায়িক কাজকর্ম পরিচালনার উপযুক্ত করে তোলার দিকে গুরুত্ব দিতে শুরু করল।

 

এভাবে বাণিজ্যিক কারণেই জাহাজে মালপত্র আনা-নেওয়াকে কেন্দ্র করে ব্রিটিশদের কাছে গুরুত্ব বাড়ছিল খেজুরি ও তৎসংলগ্ন এলাকার। বন্দর তখনও গড়ে ওঠেনি। অগত্যা তীর থেকে বেশ খানিকটা দূরে জাহাজের নোঙর ফেলে সেখান থেকে নৌকা করে অগভীর জলপথে মালপত্র আনা-নেওয়া করা ছাড়া উপায় ছিল না। ১৮ শতকে এখানেই তারপর প্রতিষ্ঠিত হলো অস্থায়ী বন্দর, সঙ্গে বন্দর অফিস। জলপথ চলাচলের একমাত্র উপায় বলে বাণিজ্যিক গুরুত্বের পাশাপাশি বিদেশি নাবিক ও অন্যান্য কাজে আগত মানুষজনের বিশ্রাম ও বিহারের কেন্দ্র হয়ে উঠল খেজুরি। স্বাস্থ্য উদ্ধারেও আসতেন মানুষজন।

 

 

এরপর মূলত বাণিজ্যিক যোগাযোগ ও তথ্য আদানপ্রদানের প্রয়োজনে বন্দর-শহর খেজুরিতে ১৭৭২ সালে প্রতিষ্ঠিত হলো দেশের প্রথম পোস্ট অফিস। এমনকী দেশের প্রথম টেলিগ্রাফ লাইনের উদ্বোধনও হলো খেজুরি পোস্ট অফিস থেকেই। প্রথম অফিসিয়াল টেলিগ্রাফ লাইন চালু হলো কলকাতা-খেজুরি-ডায়মন্ড হারবারের মধ্যে ১৮৫১ সালে। এর পরের ইতিহাস ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির আধিপত্য–ভারত তখন পুরোপুরি ব্রিটিশ শাসনের অধীনস্থ এক উপনিবেশ। নিজেদের প্রয়োজনেই বন্দর-শহর খেজুরির প্রভূত উন্নতি সাধন করল ব্রিটিশ সরকার।

 

 

তবে, উত্থানের পর পতনও আসে যথা নিয়মে। এখানে বাদ সাধলেন প্রকৃতি দেবী। মাত্র কয়েক বছর পর ১৮৬৪ সালে ভয়ঙ্কর সাইক্লোন আছড়ে পড়ল খেজুরি ও সংশ্লিষ্ট এলাকায়। সেই ঝড় তছনছ করে দিল খেজুরি শহর ও বন্দর এলাকা। ঝড়ের প্রভাব পৌঁছল কলকাতাতেও। সম্পূর্ণ ধুলিস্যাৎ হয়ে গেল পোস্ট অফিস। তথ্য বলছে ওই সাইক্লোনে মারা যান হাজার হাজার মানুষ এবং ধ্বংস হয়ে যায় অসংখ্য জলযান। সেই সর্বনাশা ঝড়ের তান্ডবে ছিন্নভিন্ন বন্দর-শহর খেজুরি দেশের প্রথম পোস্ট অফিস সহ তলিয়ে যায় কালের অতল গহ্বরে। তবে, ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে আজও দাঁড়িয়ে পুরোনো ইটে গাঁথা পোস্ট অফিসের ধ্বংসাবশেষ। সাহেবদের ব্যবহৃত হলদে রঙের প্রাচীন স্থাপত্যের অফিসবাড়িটি অবশ্য আজও অক্ষত দাঁড়িয়ে। আজও গেলে দেখতে পাওয়া যাবে অফিসের সামনের খোলা জমিতে দাঁড়ানো কালের সহযাত্রী মোটা গুঁড়ির অতি পুরাতন বিশাল বৃক্ষটিকে।

 

বঙ্গোপসাগরের ঢেউ একদা এই সমগ্র কর্মকান্ডের পাশেই আছড়ে পড়ত। জলপথে সাহেবরা নিজেদের দেশে ব্যক্তিগত চিঠিপত্র আদানপ্রদান ও মালপত্র আনা-নেওয়া করতো এই পোস্ট অফিসের মাধ্যমেই। শেষে এলো ওই সাইক্লোন। সব শেষ !! ব্রিটিশ এখানকার কলোনিকে মুক্ত করে ফিরে গেল স্বদেশে। সমুদ্রও দূরে সরে গেল প্রাকৃতিক নিয়মে। সে হোক, এই অঞ্চল, পোস্ট অফিসের ধ্বংসাবশেষ–তার তো একটা অতীব ঐতিহাসিক মূল্য ছিল এবং আছে। আজকের খেজুরি দাঁড়িয়ে তার সরল গ্রাম্য সৌন্দর্য নিয়ে। সেই সুন্দর গ্রাম্য ছবির পটভূমিতে দাঁড়িয়ে কালের গৌরবময় ইতিহাস !!

 

 


পাঠকদের মন্তব্য

কণিকা দাস লিখেছেন... ১৫ই জুলাই, ২০২৪
অজনাকে জানা আমার ফুরালো না। দারুণ ????

আপনি কি এই লেখায় আপনার মন্তব্য দিতে চান? তাহলে নিচে প্রদেয় ফর্মটিতে আপনার নাম, ই-মেইল ও আপনার মন্তব্য লিখে আমাদের পাঠিয়ে দিন।
নাম
ই-মেইল
মন্তব্য

250

    keyboard_arrow_up