ছোটোদের চাঁদের হাসি / গল্প শুধু গল্প নয় / জানুয়ারি ২০২৫

স্বাধীনতা সবার

সাত বছরের দেবাঙ্গী। দাদান-ঠাম্মির আদরের মিঠি। এ বছর ক্লাস থ্রি-তে উঠলো। এখন তার পাঠ্যবইয়ের সংখ্যা যেমন বেড়েছে, তেমনি সময় কমেছে দাদানের ঘরে আসার। তবু মায়ের চোখের আড়াল খুঁজে, পড়ার ফাঁকে এক আধবার ওঘরে ঘুরে যায় মিঠি। দাদান আরাম কেদারায় বসে দিনরাত বই পড়েন–এই মোটা মোটা, ভারী ভারী বই। ঠাম্মি পুজো-আচ্চা আর টিভি সিরিয়াল নিয়েই ব্যস্ত থাকেন। সিরিয়ালের দারুণ নেশা ঠাম্মির। ও ঘরে দিনের বেশির ভাগ সময়ই টিভি চলে বলে পুপুর মায়ের তাই কড়া নিষেধাজ্ঞা, “ও ঘরে বেশি যাবে না।”

 

মিঠির আবার ঠাম্মির কাছে রূপকথার গল্প শোনার খুব ঝোঁক। ঠাম্মির কোলে মাথা রেখে আঁচলের গন্ধ নিতে নিতে ঠাম্মির ওই রকম চোখ ঘুরিয়ে–গাল ফুলিয়ে–নানান ভঙ্গিতে হাত নেড়ে গল্প বলার কায়দাটা ভারি ভালো লাগে তার। মনে হয় যেন সত্যি সত্যি ও দেখতে পাচ্ছে সেই কুলু কুলু বয়ে যাওয়া ক্ষীর নদীটা। নয়তো মনে হয় মাঠের ধারের ঝামড়া গাছটার ডালে বসে ব্যাঙ্গমা-ব্যাঙ্গমীর ফিসফিসানি সে স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছে। আজও মিঠি ঠাম্মির ঘরে এসেছিলো তেমনই একটা জমাটি গল্প শোনার লোভে। এসে দেখে ঠাম্মির পায়ে ব্যথা বেড়েছে, ঠাম্মি হাঁটুতে আয়ুর্বেদিক তেল মেখে শুয়ে আছেন ।

 

মিঠি ফিরে যাচ্ছিল, দাদান বই থেকে মুখ তুলে চাপা গলায় বললো, “দিদিভাই, আজ আমি যদি তোমাকে গল্প বলি! শুনবে তো?” দাদান গল্প বলবে! মিঠি যেন নিজের কানকেই বিশ্বাস করতে পারছে না। দাদান তো পড়তে জানে। গল্প বলতেও জানে? “দাদান তুমি গল্প বলতে পারো?”

–“পারি বৈকি, দিদিভাই। তোমার ঠাম্মির চেয়ে আমার ভাঁড়ারে গল্প ঢের বেশি। ওনার তো কেবল রাজা, রানি, রাক্ষস আর খোক্কস। আমি তোমাকে আজ অন্য গল্প বলবো।”

–”কি গল্প বলবে, দাদান?” মিঠির সাগ্রহ প্রশ্ন।

“আমি তোমাকে–উমম–আমি তোমাকে আজ স্বাধীনতার গল্প শোনাবো। রাজা নয়, উজির নয়, মন্ত্রী নয়, কেমন করে আমাদের দেশের সাধারণ মানুষগুলো বীরের মতো লড়াই করে এই দেশটাকে পরের হাত থেকে উদ্ধার করেছিল, সেই গল্প।”

 

দাদান বলতে থাকেন সাঁওতাল বিদ্রোহের সিধু-কানহুর গল্প। সিপাহী বিদ্রোহের মঙ্গল পান্ডের গল্প। অরবিন্দ–বাঘা যতীন–ছোট্ট ক্ষুদিরামের গল্প। মিঠি হারিয়ে যায় সেই সব বীরত্বের সত্যি কাহিনিতে। সে পার্সোনালিটি চেনার বইতে দেশবন্ধুকে দেখেছে। নেতাজির ছবি দেখেছে। স্বামী বিবেকানন্দের গেরুয়া শান্ত ছবি দেখেছে। এঁরা সবাই বীর ! তিনরঙা ওই পতাকাটা অর্জন করতে এতো মানুষের দান ! যত শুনছে তত যেন  ঘোর লেগে যাচ্ছে দিবাঙ্গীর। দাদান বলল, “রাত হয়েছে মা এক্ষুনি ডাকবে, বাকিটা কাল বলবো, কি বলো দিদিভাই!”

আরও গল্প না শুনে যেতে মন সরছিল না মিঠির। মায়ের হাঁক শুনে অনিচ্ছা সত্ত্বেও মুখ কাঁচুমাচু করে বিদায় নিলো। যাবার আগে দাদানের থেকে কথা আদায় করে নিয়ে গেলো আগামিকাল, ইন্ডিপেন্ডেন্স ডে-তে তাদের ছাদে তিনরঙা পতাকা তুলতে হবে।

 

রাতে মিঠির ঘুম এল না। কেবলই ভাবছে, এই বুঝি বেলা হয়ে যাবে! ভোর না হতেই উঠে পড়লো সে। দাদান বলেছে আজ থেকে সাতাত্তর বছর আগে এই দিনে আমাদের দেশ স্বাধীন হয়েছিল মধ্যরাতে। সেদিন মানুষজন রাতেই রাস্তায় নেমে পড়েছিল আনন্দে। দেশ স্বাধীন, সে কি কম গৌরবের! কত রক্ত–কত প্রাণের বিনিময়ে! মিঠি সকাল সকাল ব্রাশ করে মুখ-হাত ধুয়ে সোজা চলে এল দাদু- ঠাম্মির ঘরে। আজ আর মা বকবে না। আজ স্কুলেরও ছুটি। তাগাদা লাগালো দাদানকে, “কখন যাবে ছাদে? কখন পতাকা তুলবো আমরা?”

আগ্রহে অধীর হয়ে ওঠা মিঠিকে দাদু বলল, “আরে দাঁড়াও মিঠিদিদি! তার আগে তো আমাদের বারান্দায় যেতে হবে। তোমার কাকাইয়ের পোষা পাখিগুলোকে বন্দিদশা থেকে মুক্ত করতে হবে তো!

 

মিঠি তো অবাক। ”কাকাইয়ের শখ করে পোষা পাখিগুলো ছেড়ে দেবে? কাকাই রাগ করবে না?”

“শোনো দিদিভাই আমরা যখন বিদেশিদের হাতে পরাধীন ছিলাম, সে যন্ত্রণা বলে বোঝানো যায় না। আমি বুঝি দিদি, পাখিগুলোও খাঁচায় আটকা পড়ে খুব কষ্ট পাচ্ছে। ওদের জায়গা তো খোলা আকাশ। ওদের জায়গা তো গাছগাছালি। এই ধরো তোমাকে যদি এখান থেকে কেউ চুরি করে নিয়ে গিয়ে কোথাও আটকে রাখে, তোমার খারাপ লাগবে না? বলো! ভেবে বলো!” দাদান বলে।

“লাগবে তো। খুব খারাপ লাগবে। খুব কান্না পাবে আমার।” মিঠির ঝটিতি উত্তর।

 

কালীকিঙ্করবাবু বারান্দার দিকে আঙুল তুলে চুপিচুপি বলেন, “ওই শোনো, পাখিগুলোও তো কাঁদছে। ওদের আপনজনের জন্য কাঁদছে। আকাশটার জন্য কাঁদছে। নিজের বাড়ি যাবার জন্য কাঁদছে। এই বেলা চলো, চুপিচুপি খাঁচার দরজাটা খুলে দিয়ে ওদের মুক্ত করি! এসো! এটাই হোক আঠাত্তরতম স্বাধীনতা দিবসে আমাদের প্রথম কাজ।”

মিঠি খুব খুশি। হাততালি দিয়ে লাফিয়ে ওঠে, “কি মজা! কি মজা! যা তোরা, আজ থেকে তোরাও স্বাধীন।” কালীকিঙ্কর বাবু নাতনির কানে ফিসফিস করে বলেন, “কাকাইকে বোলো না যেন! বাড়ির কাউকে বোলো না একথা, প্রমিজ? গিফট আছে তোমার জন্য। দারুন গিফট!”

 

ঘরে এসে দাদান ধবধবে পাঞ্জাবী আর ট্রাউজারটা গলিয়ে নিয়ে আলমারি থেকে গতকালের কিনে আনা সিল্কের তেরঙ্গা পতাকাটা বের করলেন। তারপর নাতনির হাত ধরে সোজা ছাদে। পতাকা তুলে তার নিচে দাঁড়ালেন নাতনির হাত ধরে। বললেন, “তোমাদের স্কুলে যে অ্যান্থামটা রোজ প্রেয়ারের সময় গাও,মনে আছে ? ওটারই বাংলা গানটা আমি গাইবো। তুমি আমার সাথে শুধু সুর মিলিয়ো, কেমন? পারবে তো?”

–“পারবো।” আজ মিঠি নিজেও  যেন একটা উড়ন্ত পাখি হয়ে গেছে। এত আনন্দে সে অভিভূত। তার মনে উৎসবের আমেজ। দাদানের মতো কপালে হাত ঠেকিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে গাইছে জাতীয় সংগীত। দাদান বলছে, এ গান আমাদের জন্যে রবিঠাকুর লিখেছেন।

 

পতাকা তোলার পর্ব মিটিয়ে ওরা নিচে আসে। ততক্ষণে বাড়ির সবাই উঠে পড়েছে। দাদান ড্রয়ার খুলে একটা বড় সেলিব্রেশন বাক্স আর তিন রঙের অনেক বেলুন হাতে দিয়ে বললেন, “এগুলো তোমার আজকের উপহার। নাও, ধরো। আমাদের কাজ কিন্তু এখনও শেষ হয়নি।”

“আরো কি কাজ বাকি আছে দাদান ?”

দাদান বললেন, “আসল কাজটাই তো বাকি দিদিভাই। আমরা আজ পাঁচটা চারাগাছ লাগাবো উঠোনে। তারপর তোমার মতো ছোট ছোট ছেলে-মেয়েদের খাবারের প্যাকেট দেব, তারপর শেষ হবে আমাদের আজকের দিন উদযাপন।”

সঙ্গে সঙ্গে মিঠি বলে ওঠে, “না না দাদান, তারপর ফ্রিডম ফাইটারদের বাকি গল্পগুলো শুনবো। তবে তো উদযাপন।”

কালীকিঙ্করবাবু হাসতে হাসতে নাতনির মাথায় স্নেহের হাত বুলিয়ে দিয়ে বলেন, “ঠিক! ঠিক! আমি ভুলে যাচ্ছিলাম। এ ভারি অন্যায় আমার! ভাগ্যিস তুমি মনে করিয়ে দিলে!”


পাঠকদের মন্তব্য

কোন মন্তব্য পাওয়া যায়নি

আপনি কি এই লেখায় আপনার মন্তব্য দিতে চান? তাহলে নিচে প্রদেয় ফর্মটিতে আপনার নাম, ই-মেইল ও আপনার মন্তব্য লিখে আমাদের পাঠিয়ে দিন।
নাম
ই-মেইল
মন্তব্য

250

    keyboard_arrow_up