ছোটোদের চাঁদের হাসি / গল্প শুধু গল্প নয় / ফেব্রুয়ারি ২০২৫

বোকা হবো

“কিরে অভি, তোর পেন্সিলবক্সে পেন-পেন্সিল-ইরেজার কিছুই তো নেই!”–অভির মা রবিবারে অভির স্কুলের ব্যাগ পরিষ্কার করার সময় ওর পেন্সিলবক্স খুলে ফাঁকা বক্সটা দেখেই প্রশ্ন ছোঁড়ে।

    অভি মায়ের কথা শুনে ছুটে এসে পেন্সিলবক্সটা মায়ের হাত থেকে ছোঁ মেরে নিয়ে দেখে, সত্যিই পেন্সিলবক্সে কিছুই নেই! ফাঁকা পেন্সিলবক্সটা দেখে অভি মায়ের মুখের দিকে কাঁদো কাঁদো দৃষ্টিতে তাকায়।

     মা খালিব্যাগটা নিয়ে হাফবালতি সার্ফের জলে চুবিয়ে দিয়ে বকবকানি ঢঙে ছেলের উদ্দেশ্যে বলতে থাকেন, আজকালকার ছেলেপিলেরা কত চালাক-চতুর। তারা ফাঁকা পেন্সিলবাক্স স্কুলে নিয়ে গিয়ে পেন-পেন্সিলে বাক্স ভর্তি করে বাড়ি ফেরে। আর আমার হাঁদারাম ছেলে, টিফিনবাক্স খালি করে বন্ধুদের খাওয়ায়। পেন্সিলবাক্স  খালি করে বাড়ি ফেরে। বড় হয়ে একটা হাঁদা-বোকা তৈরি হবে।

   অভি মনখারাপ করে মাথা নিচু করে মায়ের কথা দুকান ভরে হজম করতে থাকে।

     অভির মায়ের ছেলেকে নিয়ে অনেক আক্ষেপ–ছেলে তার চালাক-চতুর, করিৎকর্মা হবে, ছটফটে হবে। তা না, একদম ধীরস্থির, শান্তশিষ্ট, গোবেচারা। গোবেচারা তো বটেই। এই তো গত রবিবার ওর ক্লাসের একটি ছেলে তার মায়ের সঙ্গে বেড়াতে এসেছিল। ক্লাসের বন্ধু আসার পর তার সঙ্গে গল্প জুড়ে দিল অভি। বন্ধুকে, বন্ধুর মাকে কী খাওয়াবে, সেই চিন্তায় ব্যস্ত হয়ে পড়ল। মায়ের কানের কাছে গিয়ে ফিসফিস করতে থাকে, মাগো মা, ভালো ভালো খাবার করে খেতে দাও।

 

বন্ধুকে বসিয়ে ভালো-মন্দ খাওয়ানোর পর কত গল্পগুজব করল। তা প্রায় এক ঘন্টা সময় ধরে বন্ধুর সঙ্গে গল্প হলো। এবার বন্ধুর যাবার সময় বন্ধুকে কী দেবে, এই নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। একটা পেনের বাক্স, একটা নতুন ডায়েরি, বাবার আলমারি থেকে একটি গল্পের বই বন্ধুকে উপহার দিল।

বন্ধু আর বন্ধুর মা বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাবার পরে অভি মাকে বলতে শুরু করে, “জানো মা, অন্তুরারা খুব গরিব। এবার পুজোর সময় ওকে একটা জামা কিনে দেবে মা?”–এমনই গোবেচারা, সাদাসিধে ছেলে অভি।

 

আজ প্রায় সারাদিনটাই মনখারাপে কাটলো অভির মায়ের। ছেলের কথা ভেবে ভেবে মনে মনে স্বগতোক্তি করতে থাকে–আজকালকার যুগে এমন ছেলেপিলে হয়! একদিন তো নিজের সবই উজাড় করে দেবে মানুষকে। নিজের বলতে কিছুই থাকবে না। এ যুগে আশেপাশের মানুষরা যা চালাক, এমন বোকা পেলে যত পারে হাতিয়ে নেবে। ঠকিয়ে ছাড়বে। কী যে হবে ওর ভবিষ্যৎ…? ওর বয়সী ছেলেপিলেরা অন্যেরটা খেয়ে, অন্যেরটা নিয়ে বাড়িতে ফেরে, আর ও ঘরের জিনিস নিয়ে বাইরে বিলিয়ে আসে…!

   অভির মায়ের সারাদিনের মনখারাপে খুশির প্রলেপ পড়ল সন্ধ্যার পর। খুশির কারণ একমাত্র ভাই ফোন করে বলল, দিদি, তোর বাড়িতে আসছি বেড়াতে। সাড়ে আটটা-নটার মধ্যে ঢুকে যাচ্ছি।

   সে কথা শুনে মোটামুটি খুশি খুশি মনে অভির মা ভাইকে বললো, একটা কথা শোন, অভি এই বয়সেই দাতাকর্ণ হয়ে গেছে। ঘরের জিনিস বন্ধুবান্ধবকে বিলিয়ে বেড়ায়। স্কুলের টিফিনবাক্সে যা দিয়ে দিই, বন্ধুবান্ধবকে খাইয়ে আসে। এখানে এসে একটু বুঝিয়ে বলিস তো! এখন থেকে না বোঝালে তো বড় হলে আলাভোলা বোকা ভেবে সকলে ঠকিয়ে খাবে…!

–তুই একদম চিন্তা করিস না দিদি। অভি তো খুব ভালো ছেলে। আমাদের গর্ব। মনটা খুব ভালো-উদার। ও জীবনে অনেক বড় হবে…I

 –হ্যাঁ হ্যাঁ, তুই তো এটাই বলবি। যাই হোক তাড়াতাড়ি আয়। এসে প্রিয় ভাগ্নেকে জিজ্ঞেস করে দেখ বড় হয়ে কী হবে, তালগাছ না কলাগাছ। রাখলাম।

–বটগাছ হবে, বুঝলি বটগাছ…লাইনটা কেটে গেল।

 

অভির মামা বাড়িতে ঢোকার মুখেই অভির বাবার সঙ্গে দেখা। শালা-জামাইবাবু একসঙ্গে বাড়িতে ঢোকে। রাত্রি নটা বেজে গেছে। মামা ভাগ্নার জন্য অনেক উপহার নিয়ে এসেছে। ঘরে ঢুকেই ওয়াশরুমে গিয়ে হাত-মুখ ধুয়ে ভাগ্নাকে নিয়ে বসে গেল। মামার থেকে নানান উপহার পেয়ে অভি খুশিতে ডগমগ।

  মামা তুমি অনেকদিন থাকবে তো–এটুকু বলে প্রথমেই অভি খুশির অভিব্যক্তি প্রকাশ করল।

–ঠিক আছে, ঠিক আছে। ছমাস থেকে যাব তোর সঙ্গে। পড়াশোনা কেমন চলছে আগে বল?

–খুব ভালো মামা।

–পড়াশুনার সঙ্গে খাওয়া-দাওয়াটা ঠিকমতো করছিস তো?

–হ্যাঁ মামা।

–স্কুলের টিফিনবক্সে মা যা যা টিফিন দিয়ে দেয় সব ঠিকমতো খাস তো, নাকি ফেলে-ছড়িয়ে বন্ধুবান্ধবকে বিলিয়ে দিস?

মামার এ প্রশ্ন শুনে অভি একটু ঘাবড়ে যায়। মামার মুখের দিকে তাকিয়ে আমতা-আমতা করে বলে, খা…খাই তো। সবই আমি খাই, বন্ধুরা অল্প খায়।

অভির মুখ অন্ধকার দেখে, মামা ভাগ্নাকে জড়িয়ে ধরে আস্তে আস্তে বলে, তুইও খাবি, বন্ধুদেরও দিবি। বন্ধুরা যত চায় তত দিবি, ঠিক আছে?

–মামার মুখ থেকে এ কথা শুনে খুশিতে অভির চোখমুখ উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। মুখমন্ডল থেকে শিশুসুলভ খুশির ঝরনা ঝরে পড়তে থাকে। মনে মনে ভাবে, মামা তার পাশে আছে।

 

    এরমধ্যে অভির মা চা-বিস্কুট, মিষ্টিতে প্লেট ভরে মামার সামনে রাখতে রাখতে বলে, ভাগ্নাকে জিজ্ঞেস করত, সারাজীবন এমন হাবাগোবাই থাকবে, নাকি একটু চালাক-চতুর হবে!

–আরে তুই এত চিন্তা করিস না তো। অভি হচ্ছে আমার ভাগ্না, আমার। ও জীবনে অনেক বড় হবে, বুঝলি?

–বড় হবে না ছাই।  নিজেরটুকু অন্যকে দিয়ে ভিখারি হবে!

–আচ্ছা অভি, তুই মাকে বলে দে তো বড় হয়ে কী হবি?

মামার এই প্রশ্নে অভি কয়েক সেকেন্ডের জন্য গম্ভীর হয়ে যায়। পরক্ষণেই স্বাভাবিকভাবে বলে,

–বড় হয়ে, বড় হয়ে… বোকা হবো।

ভাগ্নার মুখ থেকে এমন উত্তর শুনে অভির মামা স্তম্ভিত হয়ে নিজের দিদির মুখের দিকে হাঁ করে চেয়ে থাকে। পরক্ষণেই মুখ নামিয়ে অভির দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে, তুই বড় হয়ে বোকা হবি কেন?

অভি মায়ের মুখের দিকে একবার তাকিয়ে বলে, মা তো সবসময় বলে, আমার বয়সী সব ছেলেপিলেই চালাক। কেউ বোকা নেই। তারা অন্যকে ঠকিয়ে নিজেদের পেন্সিলবাক্স ভর্তি করে নিয়ে বাড়ি ফেরে। তার জন্য আমি বোকা হব। সব চালাক লোকেরা যখন অন্যকে ঠকায়, আমি বোকা হলে আমি তো কাউকে ঠকাতে পারবো না। ঠাকুরও আমাকে ঠকাবে না…!

 –ছোট্ট অভির কথা শুনে তার মামা ও মা ক্ষণিকের জন্য বাকরুদ্ধ হয়ে অভির মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। তারপর অভির মামা দু-চোখের জল মুছতে মুছতে নিজের দিদির দিকে তাকিয়ে বলে, তোর অভির জন্য তোর গর্ব করা উচিত দিদি। আমি আমার ভাগ্নার জন্য গর্বিত…!

 


পাঠকদের মন্তব্য

কোন মন্তব্য পাওয়া যায়নি

আপনি কি এই লেখায় আপনার মন্তব্য দিতে চান? তাহলে নিচে প্রদেয় ফর্মটিতে আপনার নাম, ই-মেইল ও আপনার মন্তব্য লিখে আমাদের পাঠিয়ে দিন।
নাম
ই-মেইল
মন্তব্য

250

    keyboard_arrow_up