ছোটোদের চাঁদের হাসি / গল্প শুধু গল্প নয় / ফেব্রুয়ারি ২০২৪

একটি বাঁদরছানা

তোমরা অনেকেই হয়তো জিম করবেটের নাম শুনেছ। কেউ কেউ হয়তো জঙ্গল-সাফারিও করে এসেছ জিম করবেট ন্যাশনাল ফরেস্টে। জিম করবেট ফরেস্ট ঘুরতে গিয়ে আমার নিজের এক বিচিত্র অভিজ্ঞতা হয়েছিল। সেই গল্পই আজ তোমাদের জানাব। জিম করবেট। পুরো নাম এডোয়ার্ড জেমস করবেট। ইংরেজ আমলে তিনি আর্মির কর্নেল ছিলেন। সুদক্ষ হান্টার এবং প্রকৃতি-প্রেমী জিম করবেট বহুদিন উত্তরাখন্ডের কুমায়ুন অঞ্চলের দায়িত্বে ছিলেন। সেইসময় তিনি এই জঙ্গল নিয়ে অনেক চিন্তা-ভাবনা করেছিলেন।

 

আগে ভারতের সব ফরেস্টই ছিল রাজা-রাজড়া এবং ধনী ও ক্ষমতাশালী মানুষদের মৃগয়াভূমি। নিরীহ পশুপাখিদের শিকার করে আমোদ-প্রমোদে মেতে উঠত তারা। বনভূমিকে জাতীয় সম্পদ হিসেবে গণ্য করা, সুরক্ষিত রাখার জন্য শিকার নিষিদ্ধ করা এবং ন্যাশনাল পার্ক হিসেবে ঘোষণা করার নেপথ্যে জিম করবেটের বড়ো ভূমিকা ছিল। প্রথমে এই ফরেস্টের নাম ছিল ‘হ্যালি ন্যাশনাল পার্ক’। ১৯৫৭ সালে জিম করবেটের সম্মানে এই ফরেস্টের নামকরণ হয় ‘জিম করবেট ন্যাশনাল ফরেস্ট‘। এই ফরেস্ট ভারতের সবচেয়ে বড়ো, সবচেয়ে পুরনো এবং প্রথম ঘোষিত ন্যাশনাল ফরেস্ট অর্থাৎ জাতীয় অরণ্য।

 

আমার সুযোগ হয়েছিল উত্তরাখন্ডের হিমালয়ের ঢালে বিশাল এলাকা জুড়ে থাকা এই ফরেস্ট ঘুরে আসার। দিল্লী থেকে ২৭০ কিমি দূরে রামনগর হয়ে ফরেস্ট এরিয়ায় রিসর্টে পৌঁছতে আমাদের প্রায় সাড়ে ছ-ঘন্টা সময় লেগে গেল। পরদিন আমরা দুবার জঙ্গল-সাফারি করলাম, সকালে এবং বিকেলে। হরিণ, ময়ূর, বাঁদর, নানারঙের পাখি ইত্যাদি ছাড়াও চোখের সামনে বাঘ, হাতি সবই দেখার সৌভাগ্য হয়েছে। কিন্তু সে গল্প আজ নয়।

 

তৃতীয়দিনে আমাদের বেশ কয়েকটা প্রোগ্রামের মধ্যে প্রথমে ছিল কোশী নদী, ব্রিজ পেরিয়ে নদীর ওপারে গার্জিয়া দেবীর মন্দির দর্শন। ১১ কিমি পাহাড়ী পথ অতিক্রম করে কোশী নদীর কাছে পৌঁছলাম। চতুর্দিকে জঙ্গলের মাঝে নুড়ি-পাথর সঙ্গে নিয়ে তীব্রগতিতে ছুটে চলেছে কোশী নদী। চমৎকার দৃশ্য l ব্রিজের ওপারে গার্জিয়া দেবীর মন্দির ঘুরে এপারে এসে একটা বড়ো গাছের নিচে বাঁধানো বেদিতে বসলাম আমরা। বেশ কয়েকটা ছোটো ছোটো স্টল আছে, সব মন্দিরের কাছেই যেমন থাকে। পুজোর জিনিস–ফলমুল, মিষ্টি, বিস্কুট এসবের স্টল। এখানে জনবসতি তেমন নেই। গাছ-গাছালির  ফাঁকে ফাঁকে দু-চারটে ছোটোখাটো ঘরবাড়ি উঁকি দিচ্ছে।

 

ব্রিজের কাছেই একটা বাড়ি নজরে এল। দেওয়াল জুড়ে বিচিত্র রঙের আল্পনা। প্রচুর বাঁদর বসে আছে ব্রিজের মাথায়–হুটোপুটি করছে গাছের ডালে। কুকুর-বেড়ালও ঘুরে বেড়াচ্ছে। ভক্তরা খাবার-দাবার ছুঁড়ে দিচ্ছে। আর ওরা  চিৎকার করে খাবার খেতে আসছে। কাছের বাড়িটা থেকে একটা এগারো বারো বছরের মেয়ে বেরিয়ে এল। আমি তার নাম জিজ্ঞেস করলাম। সে বলল তার নাম গঙ্গা। ওদের পরিবার মন্দিরের পুরোহিতের কাজ করে । দু -বছর আগে ওর বাবা সকালে নদীতে স্নান করতে গিয়ে বাঘের কবলে পড়ে মারা গেছে। তারপর ঘাটে কাঁটাতারের বেড়া দেওয়া হয়েছে। হঠাৎ হৈ-হট্টগোল শুনে দেখি একটা ছোটোখাটো ভিড়। আর কুকুরের চিৎকার। তাড়াতাড়ি উঠে ভিড় ঠেলে উঁকি দিয়ে দেখি একটা ছোট্টো বাঁদরছানা পড়ে আছে মাটিতে । তাকে ঘিরেই জটলা। শুনলাম এক ভক্ত খাবার দিচ্ছিল। তখন একটা বাঁদর খাবার নিতে নেমেছিল। কুকুরের তাড়া খেয়ে ভয়ে পালাতে গিয়ে তার ছোট্টো ছানাটা কোল থেকে পড়ে গেছে। মনটা খারাপ হয়ে গেল। ছানাটা বেঁচে আছে কিনা কে জানে?

 

তখনই “তফাত যাও তফাত যাও“ বলে গঙ্গার হাত ধরে এগিয়ে এলো এক বয়স্কা মহিলা। গঙ্গার হাত থেকে একটা পুরনো কাপড় নিয়ে ছানাটাকে সযত্নে জড়িয়ে নিয়ে উঠে দাঁড়াতে আমি এগিয়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, নমস্তে মাইজি। আপ অব কেয়া করেঙ্গে ইসে লে কর।

উত্তর পেলাম, কেয়া করু। ইসে পহলে বচানা হ্যায়। বহোত ছোটা হ্যায় ইয়ে বাচ্চা । উসকে বাদ বনদপ্তর কো খবর কর দেঙ্গে। ও লোগ আ কে লে যায়েগা। ইয়ে সব ইধার কা রোজ কা মামলা হ্যায় জি।

– অউর ইসকা মা নেহি আয়েগা লেনে কে লিয়ে ?

–আ সকতে হ্যায়। পর ইসে তো রাস্তে পর ফেক কর নেহি জা সকতে হ্যায় না!

দাদি-নাতনি ভেতরে চলে গেল। আমি ভাবছিলাম দাদির কথা। কি দরদী মন। হয়তো নিরক্ষর, গরীব মানুষ। কিন্তু ভালোমানুষ হবার জন্য একাডেমিক কোয়ালিফিকেশন বা টাকাপয়সা দরকার হয় না। দরকার ভালোবাসা আর সহানুভূতি।

 


পাঠকদের মন্তব্য

তনুজা চক্রবর্তী লিখেছেন... ১৪ই ফেব্রুয়ারি, ২০২৪
লেখক এখানে ভ্রমণ আর গল্প পাঠ দুটোই করালেন। শিশুদের উপযোগী সুন্দর লেখা। খুব ভালোলাগল।

আপনি কি এই লেখায় আপনার মন্তব্য দিতে চান? তাহলে নিচে প্রদেয় ফর্মটিতে আপনার নাম, ই-মেইল ও আপনার মন্তব্য লিখে আমাদের পাঠিয়ে দিন।
নাম
ই-মেইল
মন্তব্য

250

    keyboard_arrow_up