ভ্যাম্পায়ার জোঁকের কবলে
তপেন্দ্রকুমার পাল
আমার হিমালয়ে বিচরণের অভিজ্ঞতা তিন দশকের। সেই অভিজ্ঞতা থেকেই দেখেছি হিমালয় অভিযানে পদে পদে বিপদ। তবে, আজ আমি এক বিচিত্র ও অকল্পনীয় বিপদের কাহিনি শোনাব। আমি ও আমার সহযাত্রী রাজু, দুজন মিলে আকাশভাঙা বৃষ্টি ও একরাশ দুশ্চিন্তা মাথায় নিয়ে সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি হাজির হলাম ইয়কসামে। ইয়কসাম তখন প্রত্যন্ত জনপদ। মাত্র গুটিকয়েক বাড়ি। এখান থেকেই শুরু হলো ঘন জঙ্গলের মধ্য দিয়ে চড়াই বেয়ে ওঠা।
ভ্যাম্পায়ারের জাতভাই
সেদিন সারারাত ধরে চললো অবিশ্রান্ত বর্ষণ। এই বর্ষাতেই জোঁকেরা তাদের নিরাপদ আশ্রয় ছেড়ে বাইরে বেরিয়ে এসে খাদ্যের খোঁজ করে। খ্যাদ্য মানে গাছের রস অথবা প্রাণীর রক্ত। লম্বায় দু-তিন ইঞ্চি, সরু লিকলিকে, সরীসৃপ জাতীয় এই প্রাণীটি মূলত পরজীবি। শরীরটা রবারের মতো, টানলে লম্বা হয়। মুখের দিকটা পেরেকের মাথার মতো চ্যাপ্টা। এই অংশ দিয়ে আগে নিজেকে মানুষের শরীরের সাথে আঠার মতো আটকে নেয়। তারপর একপ্রকার লালারসের সাহায্যে শরীরের ঐ অংশটিকে অবশ করে শুঁড় ঢুকিয়ে রক্ত শোষণ করতে থাকে।
কিছুক্ষণের মধ্যে ওই লিকলিকে সুতোর মতো শরীর বেলুনের মতো ফুলে উঠে আঙুলের মতো আকার নেয়। অসাড় থাকায় টের পাওয়া যায় না, শরীরের কোথায় জোঁক লেগেছে। টের পাওয়া যায় রক্ত দেখে। সে আরেক বিপদ। আমরা জানি রক্তের মধ্যে থাকা ফাইব্রিনোজেন থ্রমবিন কাটা অংশের মধ্য দিয়ে বাইরে এলে বাতাসের অক্সিজেনের সংস্পর্শে এসে অদ্রাব্য ফাইব্রিনে পরিণত হয়ে রক্তকে জমাট বাঁধতে সাহায্য করে। কিন্তু জোঁকের লালারস এই কাজটি করতে দেয় না। ফলে জোঁক-লাগা অংশ থেকে ক্রমাগত রক্তপাত হতে থাকে। পোশাক-আশাক লাল হয়ে ওঠার পর টের পাওয়া যায় জোঁক ধরেছে।
উপেক্ষাই কাল হলো
ইতিপূর্বে বহুবার সিকিমে যাওয়ার ফলে এটা জানা ছিল, কীভাবে নুনের পুঁটলি বা তামাকপাতা দিয়ে জোঁকের আক্রমণ ঠেকাতে হয়। সেই মতো ব্যবস্থাও মজুত ছিল। যদিও আমার পূর্ব-অভিজ্ঞতা ছিল, মাটিতে বিচরণকারী জোঁক নিয়ে। ইয়কসাম থেকে রওনা দেবার আগে প্যান্টের নিম্নাংশ মোজার মধ্যে ঢুকিয়ে লেস দিয়ে শক্ত করে বেঁধে নিয়েছিলাম, যাতে ওরা মোজা বা প্যান্টের ফাঁক দিয়ে শরীরের নাগাল না পায়। আর হাতে ছিল নুনের পুঁটলি। তখনও জানি না, সামনে আমাদের জন্য কী অপেক্ষা করে আছে !
এক চিলতে পায়ে চলা পথ। দুপাশে ঘন জঙ্গল। বড় বড় গাছের ডালপালা শাখা প্রশাখা বিস্তার করে রাস্তার উপর ছাউনির মতো ঢেকে দিয়েছে। নিশ্চিন্ত মনেই হাঁটছিলাম। হটাৎ রাজুর আতঙ্কিত কণ্ঠের ডাকে সম্বিৎ ফিরে এলো–দাঁড়ান, আপনার মাথায়-পিঠে প্রচুর জোঁক। আমি দাঁড়াতেই, ও হাত দিয়ে টেনে সব ছাড়িয়ে দিল। তাকিয়ে দেখি, ওর গায়েও প্রচুর জোঁক। আমিও একইভাবে ছাড়িয়ে দিলাম। ভাগ্য ভালো কোনওটাই শরীরের নাগাল পায়নি। এর পরের দশ-পনের মিনিটের যাত্রাপথ একে অপরের গায়ে সেঁটে থাকা জোঁক ছাড়ানোর মধ্য দিয়েই কাটল। এরপর যা আবিষ্কার করলাম, তা রীতিমতো ভয়ের। জোঁকের দল আছে গাছের ডালে-পাতায়। নিচ দিয়ে মানুষ যেতে দেখে, উপর থেকে লাফ দিয়ে পড়ছে গায়ে-মাথায়। এদিকে কোথাও দু-দণ্ড দাঁড়ানোর উপায় নেই। দাঁড়ালেই মাটির জোঁক কিলবিল করে জুতো ছাড়িয়ে উঠে আসবে শরীরের উর্দ্ধাংশে।
চরম পরিস্থিতি
এইভাবে একে অপরের জোঁক ছাড়াতে ছাড়াতে বিকেল চারটে নাগাদ বিধ্বস্ত অবস্থায় এসে পৌঁছালাম সাচেনে। এই নামটুকু ছাড়া এখানে আর প্রায় কিছুই নেই। থাকার মধ্যে আছে একটা গোট মানে পশুপালকদের অস্থায়ী ঘর। সাধারণত কেউ থাকে না, নিতান্ত প্রয়োজনে ওরা রাতটুকু কাটায়। দরজা খোলাই থাকে। সম্পত্তি বলতে কিছু শুকনো কাঠ, জ্বালানি হিসাবে ব্যবহার করার জন্য। ওরাই জঙ্গল কেটে সাফসুতরো করে এক চিলতে খোলা জায়গায় গোটটা বানিয়েছে কাঠ-মাটি দিয়ে। আমাদের আজ রাতের ঠিকানা এটাই। কিন্তু ওখানে যাবো কীভাবে ?
দেখলাম, জায়গাটা আমাদের রাস্তা থেকে মিটার দশেক দূরে। একটা সরু পথ আছে বটে, তবে, তা ঢেকে গিয়েছে দুপাশের জঙ্গলে। আমাদের ওই জঙ্গলের মধ্য দিয়েই যেতে হবে। তাই যুদ্ধের প্রস্তুতি হিসাবে রণসাজে সাজতে হল। বর্ষার জন্য আনা প্লাস্টিকের টোকা দিয়ে স্যাক সমেত গোটা শরীরটাকে মুড়ে নিলাম। দেখে নিলাম কোথাও কোনও ফাঁক-ফোঁকর আছে কিনা। এবার এক দৌড়ে ওই দশ মিটার জঙ্গল পেরিয়ে গা থেকে টোকা খুলে মাটিতে ফেলে দিলাম। মেরে-কেটে কয়েক সেকেন্ড সময় গিয়েছে। তারই মধ্যে গোটা প্লাস্টিক ঢেকে গেছে জোঁকে। জানি চারপাশের জঙ্গলে অগণিত জোঁক। তাদের ভগ্নাংশও যদি আমাদের ছেঁকে ধরে, তাহলে আমরা আর প্রাণ নিয়ে বাড়ী ফিরতে পারব না। এদের ঘ্রাণশক্তি মারাত্মক। তাই ওরা আসার আগেই আমাদের আত্মরক্ষার ব্যবস্থা করতে হবে।
দুর্গনির্মাণ
ঘরের এক কোণে শুকনো কাঠ রাখা ছিল। আমরা স্যাকসহ ঘরের মাঝখানে বসলাম। আর আমাদের কেন্দ্র করে বৃত্তাকারে কাঠ সাজিয়ে সঙ্গে থাকা কেরোসিন তেল ঢেলে ঐ কাঠে আগুন ধরিয়ে দিলাম। অর্থাৎ আমরা আশ্রয় নিলাম অগ্নিবলয় দ্বারা নির্মিত দুর্গের মাঝে। আমাদের অনুমান নির্ভুল ছিল। ঝাঁকে ঝাঁকে জোঁকেরা আসছে বটে, তবে, আগুনের কাছে এসে থমকে যাচ্ছে। এই আগুনের বেড়া অতিক্রম করার বিদ্যে ওদের নেই। তবু নিশ্চিন্ত হবার উপায় নেই। কারণ, কোনও জায়গায় আগুন নিভে গেলে, সেই জায়গা দিয়ে ওরা বৃত্তের ভিতরে ঢুকে পড়তে পারে। তাই সারারাত জেগে থাকতে হলো, আগুন যাতে নিবে না যায়, সেদিকে সজাগ দৃষ্টি রাখার জন্য। এদিকে অন্ধকার নামতেই আতঙ্ক আরও গ্রাস করল। কোটি কোটি জোঁকের মাঝে আমরা দুটি মাত্র প্রাণী।
যাই হোক, একসময় রাত্রি শেষ হয়ে পূব আকাশে দেখা দিল আলোর আভাস। বাইরে বেরিয়ে দেখি, প্লাস্টিকের গায়ে সেঁটে থাকা জোঁকেরা খাদ্যরস না পেয়ে বিদায় নিয়েছে। মনে একটাই আশার আলো, বাকিম ছাড়িয়ে উপরে উঠলে, ঠান্ডার প্রকোপে ওদের আর দেখা যাবে না। মর্মে মর্মে উপলব্ধি করলাম, অভিযানে যত রকমের বিপদ মৃত্যুর কারণ হতে পারে, সিকিমের জোঁক তাদের থেকে কোনও অংশেই কম বিপদজনক নয়।
ছবি : লেখক
পাঠকদের মন্তব্য
250