রাধামাধব স্যার
মৃত্যুঞ্জয় দেবনাথ
পড়াতে গিয়ে রোহনের ব্যাপারটা নজরে এল রাধামাধব স্যারের। পড়া শুনছে না বিচ্ছুটা। গভীর মনোযোগে কিছু একটা দেখছে বাইরের দিকে তাকিয়ে। পড়ানো থামিয়ে অমনি পাশে এসে দাঁড়ালেন রাধামাধব স্যার। তবুও হুঁশ নেই। খেয়ালই করেনি, শিয়রে যমরাজ। স্যারের সিংহগর্জনে সম্বিত ফিরল ওর।
কী দেখছ? বাইরে হাঁ-করে? পড়া ফেলে?
উত্তর দিতে গিয়ে থতমত খেল রোহন। কী বলবে উত্তরে? জানালার ফাঁক গলে বাইরে তাকিয়ে সত্যিই অপূর্ব এক দৃশ্য দেখছিল সে। একটা ছোট্ট বেড়ালছানা একটা মা মেদি-কুকুরের দুধ খাচ্ছে। অন্য আরও দুটো কুকুরছানাও রয়েছে সঙ্গে। আশ্চর্য! তাই বলবে?
কিন্তু এ-সত্য কেমন করে বলে ও স্যারকে? তবে যে পিঠের চালাটি ভাঙবেন এক্ষুনি বেতের ঘায়ে। স্বভাবে শান্ত প্রকৃতির মানুষ রাধামাধব স্যার। মৃদুভাষীও। অথচ রাগলে ভয়ঙ্কর। হুঁশ থাকে না তখন স্যারের। বেদম মারতে থাকেন। একনাগাড়ে। নিজে চূড়ান্ত হাঁপিয়ে না-পড়া পর্যন্ত। সেদিনও ক্লাসের রবিকে এমন ডাস্টার পেটা করলেন যে, খানিকক্ষণ পিঠ বেঁকিয়েই বসে থাকতে হলো বেচারাকে। আর সোজা হতে পারে না কিছুতে। মস্ত ফোঁড়ার মতো ফুলেও উঠেছিল পিঠটা।
কী হল, চুপ যে? কী দেখছিলি বাইরে, বল? স্যার আবার জিজ্ঞাসা করলেন।
কিছু না স্যার। এমনিই–রোহন মিনমিন করল।
এমনিই! পড়াটা কে শুনবে তবে? এতক্ষণ পদের প্রকারভেদগুলো বোঝালাম। বলতে পারবি তো?
অসহায়ের মতো তাকাল রোহন।
পদ কত প্রকার বল? বলে কড়মড়িয়ে তাকালেন স্যার।
প-পদ। আমতা-আমতা করতে থাকে রোহন। বলবে কেমন করে ও! স্যারের কোনও পড়াই যে কানে যায়নি এতক্ষণ ওর। মনটা বাইরেই পড়েছিল। দৃশ্যটা অভূতপূর্ব যে!
ততক্ষণে থার্মোমিটারের পারদের মতো রাগ ঊর্ধ্বমুখী রাধামাধব স্যারের। মাথায় আগুন। দু-চোখে অগ্নিস্ফুলিঙ্গ। জমি থেকে আগাছা তোলার মতো চুলের মুষ্টি চেপে ধরলেন রোহনের। তারপর চলল পিঠে লাঠিপেটা, ঘুপ্-ঘুপ্-ঘুপ্। একটি-দুটি-চারটি-আটটি… হাঁপাতে থাকলেন রাধামাধব স্যার এরপর। হাঁপাতে-হাঁপাতেই চেয়ারে হেলান দিয়ে বসলেন। পকেট থেকে রুমালটি বের করে নিজের ঘর্মাক্ত মুখ মুছলেন। তারপর এক অদ্ভুত কান্ড করলেন। নিজেই ঝরঝর করে কেঁদে ফেললেন স্যার। আর বিড়বিড় করতে থাকলেন, এত ক’রে বোঝাই তোদের, তবু বুঝবি না! মন দিবি না পড়ায়! শুনবি না! তবে মানুষ হবি কেমন করে? ফাঁকিবাজি করে বড়ো হওয়া যায় কখনও? কক্ষনো না।
এই ছিলেন রাধামাধব স্যার। ভারী কোমল মনের মানুষ। তেমনি শান্ত, নিরীহ, সৎ। রাগতেন কদাচিৎ। রাগলে ভয়ঙ্কর। পড়াতেন অন্তর দিয়ে। ছেলেমেয়েগুলোকে নিজের সন্তানের মতো ভালোবেসে। গত হয়েছেন অনেকদিন সেই রাধামাধব স্যার। ঘুমের মধ্যেই আচমকা হার্ট অ্যাটাক। সেও অনেকদিন হলো। রোহন এখন ক্লাস ফাইভ থেকে নাইন। পুরনো বদ অভ্যেসটা এখন আর নেই ওর। পড়ার সময় অন্যমনস্ক হয় না আর ভুলক্রমেও। ক্লাস চলাকালীন জানালার ফাঁক দিয়ে তাকানো, নৈব নৈব চ। আর এসবই ঘটেছে রাধামাধব স্যারের আনুকূল্যে। বস্তুত, রোহনের এই আমূল পরিবর্তনের নেপথ্যের কারিগর একজনই, রাধামাধব স্যার। মনে হয় তিনি যেন আড়ালে থেকে সব দেখছেন।
ক-দিন যেতে প্রমাণ মিলতে থাকল হাতে-নাতে। অথচ ভূতে বিশ্বাস নেই কোনদিনই রোহনের। ব্রজমামার নিত্য মগজ ধোলাইয়ের ফল হিসেবে নিজেও বিশ্বাস করতে শুরু করেছে যে, ভূত বলে কিছু হয় না। ছিলও না কোনদিনও। পুরো ব্যাপারটাই বোগাস। গুজব, উড়ো কথা। ভূত হল দুর্বলচিত্তের মানুষের মনের ভয়জাত ফসল।
পড়তে বসে সেদিন ঘুমিয়ে পড়েছিল রোহন। স্বপ্নে দেখল,পাশে এসে দাঁড়ালেন রাধামাধব স্যার। তারপর যথেচ্ছ বকাবকি। কান্ড দেখে ভিরমি খাওয়ার জোগাড় বেচারা রোহনের। কিন্তু রাধামাধব স্যার মিষ্টি হেসে বললেন, ভয় পাসনে। মরে গেছি বটে, তবে তোর ক্ষতি তো করতে পারি না। তুই আমার সন্তানসম। নে, মন দিয়ে পড়। একদম ফাঁকি নয়। এই আমি পাহারায় রইলাম।
সেই শুরু। রাধামাধব স্যারের পাহারাদারি আজও চলছে সমানে। তারপরই আমূল বদলে যেতে থাকল রোহন। এখনকার রোহন এক্কেবারে আগের চাইতে আলাদা।
এই সেদিনও একবার ভুল করে মন বাইরে চলে গিয়েছিল রোহনের।
অমনি পাশে দাঁড়িয়ে কানটি মলে দিয়ে ক্লাসের দিকে ফেরালেন রোহানকে রাধামাধব স্যার। ধমকে বললেন, কী হচ্ছে রোহন? আবার সেই ভুল? ক্লাস চলাকালীন আবারও বাইরে তাকাচ্ছ? মনে নেই কিছু বুঝি, ফাঁকি দিলে কী হয়? মনে রাখবে, বড়ো হতে গেলে একনিষ্ঠ হতে হয়। মনোযোগী হতে হয়।
পুরস্কার বিতরণী সভায় মেমেন্টোটি হাতে দিয়ে কিছু বলতে বলা হয়েছিল রোহনকে। সবাইকে অবাক করে দিয়ে ও বলেছিল, ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার হতে চাই না। একজন শিক্ষক হতে চাই। সৎ, আদর্শবান, দরদি শিক্ষক। রাধামাধব স্যারের মতো। তুমুল হাততালিতে ভরে গেল অমনি গোটা অডিটোরিয়াম।
লাউড স্পিকারের সামনে দাঁড়িয়ে যেন স্পষ্ট দেখতে পেল রোহন, রাধামাধব স্যার এসেছেন অনুষ্ঠানে। ওই যে, দাঁড়িয়ে আছেন মঞ্চের এককোণে। রোহনের কথা শুনে মৃদু মৃদু হাসছেন তিনি। হাততালি দিচ্ছেন। আশ্চর্য !!
পাঠকদের মন্তব্য
250