ছোটোদের চাঁদের হাসি / গল্প শুধু গল্প নয় / আগষ্ট ২০২৪

জল বাঁচাও সপ্তাহ

“অকারণে খোলা কল

বন্ধ করি আমরা চল”

 

খুশি যখনই বাইরে যায়, ওর ইস্কুলের দেওয়ালের ডান দিকে দুটি লাইনের ওপরে ওর ছোটো ছোটো দুটি চোখের তীক্ষ্ণ দৃষ্টি ফেবিকুইক-এর মতো আটকে যায়। শিশুমনের বিচারে লাইন দুটি বেশ চমৎকার—-

   অকারণে খোলা কল

    বন্ধ করি আমরা চল।

 

খুশি লাইনদুটো বারবার পড়ে। সে চতুর্থ শ্রেণিতে পড়ে। ওর বিদ্যালয়ে গত সোমবার থেকে ‘জল বাঁচাও সপ্তাহ’ পালন হচ্ছে। আজ শনিবার সপ্তাহের শেষ দিন। আজ হাফস্কুল। দুই পিরিয়ড স্কুল হওয়ার পর হেডমাস্টারমশাই এবং সকল শিক্ষক-শিক্ষিকা মিলে সব শিশুদের একত্রিত করে স্কুলের মাঠে লাইন করে দাঁড় করিয়ে দিলেন। সব বাচ্চাদের সমান চারটে লাইনে দাঁড় করানো হলো। প্রত্যেক লাইনের সামনের শিক্ষার্থীর হাতে একটা করে পোস্টার। কোনো পোস্টারে লেখা–জলই জীবন। কোনো পোস্টারে লেখা–জলের মতো মূল্যবান কিছু নেই/ জল অপচয় করব না। কোনো পোস্টারে লেখা–জলের অপচয় বন্ধ না করলে একদিন পয়সা দিয়েও জল মিলবে না। কোনো পোস্টারে লেখা–অকারণে খোলা কল/বন্ধ করি আমরা চল।

 

সকল শিক্ষক-শিক্ষিকা স্কুলসংলগ্ন গ্রামের রাস্তার মধ্য দিয়ে শিশুদের নিয়ে লাইন করে যাচ্ছেন আর সকলকে দিয়ে জোরে জোরে বলাচ্ছেন, পোস্টারে লেখা স্লোগানগুলো–জলই জীবন। জলের মতো মূল্যবান কিছু নেই…অকারণে খোলা কল/ বন্ধ করি আমরা চল…এই শেষ লাইনটা খুশিকে ভীষণ আকৃষ্ট করেছে। গ্রামের রাস্তা পরিক্রমা শেষে বিদ্যালয়ের মিড-ডে-মিলের খিচুড়ি খাওয়ার পর শনিবারের স্কুল ছুটি হয়ে গেল। একে একে শিক্ষার্থীরা বাড়ি চলে গেল।

  ‌

খুশি বাড়ি গিয়ে খুশিতে ডগমগ হয়ে ব্যাগটা পিঠ থেকে কোনোক্রমে নামিয়ে দিদুনকে ধরল। দিদুনকে ধরেই শুরু করলো—অকারণে খোলা কল বন্ধ করি আমরা চল, অকারণে খোলা কল, বন্ধ করি আমরা চল…!

শুনেই দিদুন কিছুটা অবাক হয়ে বললো, “এসব কী বলছিস? এসব তোকে কে শেখালো?”

“স্যার-ম্যাডাম শিখিয়েছেন। আমাদের স্কুলের দেয়ালে লেখা আছে। আমরা সকলে আজকে গ্রামে ঘুরে ঘুরে এইসব কথা বলেছি, জানো?” খুশি বলল।

“এসব কথা বললে কী হবে?” দিদুন জিজ্ঞেস করে।

“রাস্তার কল থেকে জল নেওয়ার পর সকলে কল বন্ধ করে রাখবে।”

“খোলা রাখলে কী হবে?”

“খোলা রাখলে সব জল পড়ে শেষ হয়ে নষ্ট হয়ে যাবে। পরে আমরা দরকারের সময় খাবার জল পাবো না।”

“তোকে এসব কথা কে বলেছে? জল কখনো পড়ে পড়ে নষ্ট হয় না। যত জল কল থেকে পড়ে যায়, সব জল আবার পাতালে চলে যায়। সেখান থেকে আবার জল কলের পাইপের মাধ্যমে ওপরে ওঠে।”

“তুমি কিচ্ছু জানো না দিদুন। ম্যাডাম বলেছেন, যে জল খোলা কল দিয়ে একবার পড়ে যায়, সে জল সব মাটিতেই নষ্ট হয়ে যায়। এইভাবে জল নষ্ট হতে হতে একদিন সব জল শেষ হয়ে যাবে। আমরা আর খাবার জল পয়সা দিয়েও কিনতে পারবো না।”

“আমি তো সকালে রাস্তার কল থেকে জল ভরে কল খুলে রেখেই চলে আসি।”

“এবার থেকে জল নিয়ে কল বন্ধ করে তারপর আসবে, তা নাহলে আমি হেডস্যরকে সব বলে দেবো।”

  

খুশির দিদুন দুই-পাঁচ ক্লাস পড়াশোনা করেছেন। ভালোটা-মন্দটা অনেকটাই বোঝেন। স্কুলের

মাস্টারমশাইদের প্রতি নাতনির এত বিশ্বাস-ভক্তি দেখে খুশির দিদুন ভীষণ খুশি হলেন এবং বললেন, “তোর মাস্টার তাহলে ঠিকই বলেছেন। খোলা কল দিয়ে জল পড়ে গেলে সব নষ্ট হয়ে যায়। আমি কাল থেকে জলের বোতলগুলো ভরার পর কল বন্ধ করে রেখে আসবো।”

“শুধু তুমি বন্ধ করলে তো হবে না, তোমার পরে যারা জল নিতে যায়, তাদেরও বলে দেবে, জল নেওয়ার পর কল বন্ধ করে রাখতে।”

“ঠিক আছে বলব খন। এখন বোধ হয় ট্যাপকলে জল এসেছে। তুই হাত-পা ধুয়ে দুই বোতল জল নিয়ে আয়।”

 

পরের দিন রবিবার। সকালে দিদুনের সঙ্গে খুশিও গেল রাস্তার কল থেকে জল আনতে। দিদুনের সঙ্গে হাতে হাতে সব বোতলে জল ভরল। দিদুন ব্যাগে জলের বোতল ভর্তি করে বাড়ি চলে এলো। খুশি রাস্তার কলের কাছেই দাঁড়িয়ে রইল। অল্প পরেই পাড়ার একজন মহিলা বোতলে জল ভরতে এলো। সব বোতলের জল ভরে কল খোলা রেখেই চলে যাচ্ছিল, সঙ্গে সঙ্গে খুশি বলল,  “জল নিয়ে কল বন্ধ করে রাখবে, না হলে সব জল পড়ে নষ্ট হয়ে যাবে।”

“তোকে কে বলেছে, জল পড়ে নষ্ট হয়ে যায়? সব জল পাতালে চলে যায়…” বলতে বলতে সে চলে গেল।

খুশির মুখটা অন্ধকার হয়ে গেল! সে নিজেই কলটা বন্ধ করে গুটি গুটি পায় বাড়ি চলে এলো। ক্লাস ফোরে পড়ে। কতই বা বয়স! দিদুন প্রথমে বলল, জল সব পাতালে চলে যায়। পাড়ার মহিলাও বলল, জল পাতালে চলে যায়। তবুও তার বিশ্বাস হয় না। স্যর-ম্যাডাম যেটা বলেছেন, সেটাই ঠিক। তাই সে সকলকে বোঝাবে, জল নেওয়ার পর কল বন্ধ করতে হবে।

   

পরের দিন সোমবার। খুশি হেঁটে হেঁটে স্কুলে যাচ্ছিল। পাড়ার ভ্যানকাকু ওদিকেই যাচ্ছিল। খুশিকে দেখে ডেকে ভ্যানে তুলে নিল। ভ্যানে করে পাড়ার মোড়ে ট্যাপকলের কাছে আসতেই খুশি দেখে, ট্যাপকল দিয়ে অনবরত জল পড়ে যাচ্ছে। খুশি ভ্যানকাকুকে বলল, “কাকু একটু দাঁড়াও।”

ভ্যানকাকু দাঁড়াতেই খুশি ঝুপ করে ভ্যান থেকে নেমে খোলা কলটা বন্ধ করে আবার এসে ভ্যানে উঠল ।

ভ্যানকাকু খুশির কাজ দেখে বলল, “তুই কলটা বন্ধ করলি কেন?”

“সব জল পড়ে নষ্ট হয়ে যাচ্ছিল যে।”

“তোকে কে বলেছে, জল পড়ে গেলে নষ্ট হয়ে যায়? একটুও জল নষ্ট হয় না। সব জল পাতালে চলে যায়। আবার কল চাপলে সেখান থেকে ওপরে ওঠে।” 

“আমার স্কুলের স্যার বলেছে, যে জল বাইরে মাটিতে পড়ে যায়, সে জল সব নষ্ট হয়ে যায়।”

“তোর স্যার কিছুই জানে না! স্যারকে বলবি, সব জল পাতালে চলে যায়,” ভ্যানকাকু আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে বলল।

  

তবুও খুশি নত হওয়ার মেয়ে নয়। স্যার-ম্যাডাম যেটা বলেছেন, সেটাই ঠিক। স্যাররা অনেক পড়াশোনা জানেন। ভ্যানকাকু কি আর স্যার-ম্যাডামের মতো অত পড়াশোনা জানে? তাই ভ্যানকাকুর কথা তার মন মানতে চায় না। স্যার-ম্যাডামরা যা বলেছেন, খুশি সেটাই করবে।

সত্যি সত্যি যদি একদিন তেমন হয়, মাটির তলার সব জল শেষ হয়ে যায়! টাকা দিলেও যদি জল না মেলে, তাহলে মানুষ জল পাবে কোথায়?

   

খুশির মনটা খারাপ হয়ে যায়। ভ্যানকাকু স্কুলের সামনে নামিয়ে দেয়। খুশির শিশুমনে অনেক কথা জমে আছে। প্রথম পিরিয়ডে হেডস্যর ক্লাসে ঢোকেন। খুশির মনে অনেক প্রশ্ন। তবুও সাহস করে হেডস্যারকে কিছু জিজ্ঞেস করল না। পরের পিরিয়ডে ম্যাডাম ক্লাসে ঢুকলেন। এবারে এতক্ষণ ধরে খুশির সারা মুখে জমে ওঠা চিন্তার কালো মেঘ সরে গিয়ে খুশিতে কিছুটা উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। ম্যাডাম ক্লাসে ঢুকে চেয়ারে বসার পর খুশি সটান প্রশ্ন করে, “ম্যাম, ম্যাম, আমাদের পাড়ার ভ্যানকাকু বলছিল, খোলা কল থেকে যে জল নিচে পড়ে যায়, সব নাকি পাতালে চলে যায়। একটুও নষ্ট হয় না?”

 

খুশির কথা শুনে ম্যাম কিছুটা ধন্দে পড়ে যান–খুশির প্রশ্নের উত্তর কীভাবে দেবেন! ও ছোটোমেয়ে, শিশুমন। বড়রা যদি ওকে ভুল বোঝায়, ও কী করবে!

ম্যাম এবারে সকল শিক্ষার্থীদের উদ্দেশ্যে বলেন, “তোরা সবাই শোন, যে যাই বলুক, রাস্তায় কল খোলা দেখলেই বন্ধ করে দিবি। কারণ জল পড়ে গেলে নষ্ট হয়ে যায়। তবে ১০ বালতি জল বাইরে পড়ে গেলে, তার মধ্যে এক থেকে দেড় বালতি মাটির তলায় পাতালে যায়, বাকি জল সব মাটিতেই নষ্ট হয়ে যায়, সেসব আরো ভালো করে তোরা বড় হয়ে শিখবি। স্কুলের ছাত্র-ছাত্রীদের সে কথা জানানোর জন্যই সব স্কুলে ‘জল বাঁচাও সপ্তাহ’ পালন করা হলো …!”


পাঠকদের মন্তব্য

কোন মন্তব্য পাওয়া যায়নি

আপনি কি এই লেখায় আপনার মন্তব্য দিতে চান? তাহলে নিচে প্রদেয় ফর্মটিতে আপনার নাম, ই-মেইল ও আপনার মন্তব্য লিখে আমাদের পাঠিয়ে দিন।
নাম
ই-মেইল
মন্তব্য

250

    keyboard_arrow_up