ছোটোদের চাঁদের হাসি / দেশ-বিদেশের গপ্পো / সেপ্টেম্বর ২০২৫

এক কাঠুরে আর বাঘের গল্প

(কোরিয়ার উপকথা)

 

সে অনেকদিন আগেকার কথা।

        এক ছিল কাঠুরে। কাঠ কেটে তার দিন কাটে। তা কাটুক। কাঠ কাটার জন্য যেমন ছিল তার এক কুড়ুল, আর মজা করার জন্য ছিল এক বাঁশি। বাঁশের বাঁশি। কাজ ফুরোলে সে মনের আনন্দে বাঁশি বাজায়। আবার মন খারাপ থাকলে কাজের ফাঁকে ফাঁকে বাঁশি বাজাতে বসে। আর বাড়ি ফেরার পথে তো সে বাঁশি বাজাবেই। তার বাঁশির সুরের এমনি টান, যে তা শুনে বাচ্চারা দল বেঁধে তাকে ঘিরে ধরে আর বাঁশির সুরের তালে তালে নাচতে থাকে। যারা নাচে না, তারা স্থির হয়ে বাঁশি শোনে—কেউ নড়ে না, গাছের পাখিরাও ডাল ছেড়ে আকাশে ডানা মেলে না।

 

        একদিন হয়েছে কী—কাঠুরে কাঠ কাটতে গেছে গভীর বনে। যখন সে একমনে কাঠ কাটছে, তখন একবার তার হাতের কোপ নড়ে গেল, কার যেন পায়ের শব্দ শুনল সে। শব্দ শুনে পিছন ফিরে চেয়ে দেখে এক পেল্লায় বাঘ তার দিকে তাক করে গুটি গুটি পায়ে এগিয়ে আসছে। তা দেখে সে ‘বাবা গো’ বলে কুড়ুল ফেলে উঠে পড়ল সামনের এক মস্ত গাছে।

       মুখের গ্রাস হাতছাড়া হয়ে যায় দেখে বাঘও ‘হালুম’ বলে ডাক ছেড়ে এক লাফে সেই গাছের গোড়ায় পৌঁছল। তারপর কাঠুরেকে ধরতে গুঁড়ি বেয়ে গাছে চড়তে গেল। কিন্তু গাছের গুঁড়িটা ছিল এত পিছল যে সে হড়কে পড়ে যেতে থাকল। বারবার চেষ্টা করল সে। কিন্তু বারবারই পিছলে পড়ল। কিছুতেই গাছের ওপরে উঠতে পারল না। গাছে উঠতে না পারলে কি হয়, দুষ্টু বাঘ গ্যাঁট হয়ে গাছতলায় বসে রইল। তা দেখে ভয়ে কাঠুরের প্রাণ তো প্রায় খাঁচা ছাড়া। হায়রে, এ যাত্রা বুঝি আর বাড়ি ফেরা হল না।

 

       এদিকে অনেকক্ষণ বসে থেকে বাঘ মনে মনে খানিক হতাশ হয়ে পড়ল। কাঠুরে তো নিচে নামছে না, ধপ করে তালের মতো খসেও পড়ছে না। তাহলে কী করা ? ভাবতে ভাবতে বুঝি কোনও ফন্দি এঁটে বাঘ গাছতলা ছেড়ে গভীর বনের ভেতরে চলে গেল। আর তা দেখে কাঠুরের ধরে প্রাণ এলো। ওঃ কী ভয়ানক বিপদে না পড়েছিল সে। বাপরে, বাঘটা গেছে, বাঁচা গেছে! এই ফাঁকে চুপি চুপি সরে পড়তে পারলে বাঁচি। একথা ভেবে কাঠুরে নিচে নামতে গিয়ে দেখে, সে আর কিছুতেই নামতে পারছে না। ভয়ে তার পায়ের সাড় চলে গেছে। অনেকক্ষণ চেষ্টা করে সে পায়ের সার ফিরে পেয়ে যখন নিচে নামার জন্য তৈরি হয়েছে, তখনই অবাক হয়ে দেখে যে, একটা নয়, দুটো নয়, ছ-ছটা বাঘ সঙ্গে নিয়ে দুষ্টু বাঘটা ফিরে আসছে। ওরে বাব্বা! ভয়ে বেচারা কাঠুরে গাছের আরো দুধাপ ওপরের ডালে উঠে পড়ল।

 

         কিন্তু ওপরের ডালে উঠেই কী নিস্তার আছে? সে দেখল, বাঘের দল খুব ভালো করে তাকে নজর করছে। তারপরে, অবাক কান্ড ! বাঘের দলের সবচেয়ে কেঁদো যেটি, সেটি থেবড়ে মাটিতে বসল। ওমা,  তার ওপরে উঠল একটি বাঘ, তার উপরে আরেকটি, তার ওপরে আরেকটি, তার ওপরে আরেকটি বাঘ—এবারে কাঠুরেকে তারা ধরে ফেলে আর কী! এমন সময়ে ঘটল আরেক কান্ড। বাঁচার আর কোনও আশা নেই দেখে কাঠুরে ভাবল, যাক, মনের আনন্দে শেষবারের মতো বাঁশিটি বাজিয়ে নিই। গাছের ডালে আয়েশ করে  বসে সে বাঁশিতে ফুঁ দিল—অমনি বাঁশিতে সুর ফুটল  পিল্লিলি… পিল্লিলি… পিল্লিলি।

 

        এখন হয়েছে কী—যে মোটা বাঘটা সবার নিচে বসেছিল, সে সবেমাত্র এক ওঝাকে গিলে খেয়ে এসেছে, তখনও হজম হয়নি। ওঝা ছিল মস্ত নাচিয়ে। বাঁশির সুর শুনে তার পায়ে নাচের তাল জেগে উঠল। যে বাঘের পেটে ছিল সে, সেই বাঘও  তালে তালে নেচে উঠল। সেই বাঘ তো ছিল সবার নিচে। তার ওপরে একটা বাঘ… তার ওপরে আরেকটা… তার ওপরে আরেকটা…তার ওপরে এমনি করে তো বাঘেরা সিঁড়ি তুলে কাঠুরেকে ধরতে উঠেছিল। এখন সবচেয়ে নিচের বাঘটা যখন নেচে উঠল তখন তার ওপরে, তার ওপরে, তার ওপরে, তার ওপরে যে যে বাঘ উঠেছিল—তারা সবাই একের পর এক হুড়মুড়িয়ে মাটিতে এসে পড়ল। আর শক্ত পাথুরে মাটিতে চিৎপটাং হয়ে পড়ে সবাই জ্ঞান হারাল। সবার নিচে থাকা নাচিয়ে ওঝা-গেলা বাঘ তো সব ভুলে বাঁশির সুরে তালে তালে নাচতে লাগল।

       তা দেখে কাঠুরে এবারে বাঁশি বাজাতে বাজাতে গাছের মগডাল থেকে মাটিতে নেমে এল। বাঘেদের জ্ঞান ফিরে আসার আগেই চোঁ চাঁ দৌড়ে বাড়ির দরজায় পৌঁছে গেল।


পাঠকদের মন্তব্য

কোন মন্তব্য পাওয়া যায়নি

আপনি কি এই লেখায় আপনার মন্তব্য দিতে চান? তাহলে নিচে প্রদেয় ফর্মটিতে আপনার নাম, ই-মেইল ও আপনার মন্তব্য লিখে আমাদের পাঠিয়ে দিন।
নাম
ই-মেইল
মন্তব্য

250

    keyboard_arrow_up