ছোটোদের চাঁদের হাসি / দেশ-বিদেশের গপ্পো / সেপ্টেম্বর ২০২৪

সেরা ছেলে

(মধ্যপ্রদেশের গল্প)

 

জল নিতে এসেছেন চার ছেলের চারজন মা। গ্রামের কুয়োতলায়। কার ছেলে কত সেরা, গুণী এ নিয়ে তিনজন মা জোর তর্ক, গলাবাজি করে চলেছেন। পাশেই একটা অশ্বত্থ গাছ। তার তলায় এক বৃদ্ধ সাধু বসে আছেন। তিনি সব কথা শুনছেন। মায়েরা ছেলের প্রশংসায় এত পঞ্চমুখ যে সেদিকে কারও নজর নেই।

   প্রথম মা বললেন, “আমার ছেলের লেখাপড়ায় দারুণ মনোযোগ।  সব সময় বই পড়েই চলেছে। বড় হয়ে ও একজন মহাপন্ডিত হবে।”

     দ্বিতীয় মা বললেন, “আমার ছেলের কত মিষ্টি গলা। গলার আওয়াজ শুনলে মনে হবে কোকিল ডাকছে। গান শুনলে মনে হবে শ্রোতাদের কানে মধু ঢেলে দিচ্ছে।”

      তৃতীয় মা’ও তাঁর ছেলে নিয়ে কম গর্বিত নন। তিনি বললেন, “পড়াশোনা, গানের গলার চেয়ে বেশি দামি  বলিষ্ঠ দেহ। আমার ছেলের দারুণ স্বাস্থ্য, অসীম তার গায়ের জোর। ওকে সবাই ভালবেসে ‘ভীমসেন’ বলে ডাকে।”

     তিনজন মা তাঁদের ছেলের  গুণের ঢাক পেটাচ্ছেন। এক মা চতুর্থ মাকে বললেন, “সাবিত্রী, তোমার ছেলের গুণের  কথা কিছুই বলছ না।” মুখ নিচু করে সাবিত্রী বললেন, “আমার ছেলে খুবই সাধারণ। এসব ছেলের গুণের তুলনায় তাকে বোকাই বলা যায়।”

     এমন সময় কুয়োতলার পাশের পথ দিয়ে একটি ছেলে গুনগুন করে গান গাইতে গাইতে চলে গেল। তার মা সাগ্রহে বলে ওঠেন,”‘ওই আমার ছেলে। বলিনি ওর গলা খুব মিষ্টি।”

      তারপর ওই পথে আর একজন ছেলে এল । হাতে খোলা বই। বোঝা যায়, পথ চলতে চলতে সে বই পড়ে চলেছে। পড়ুয়া ছেলের মা’র  চোখ-মুখ গর্বে উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। তিনি বলেন, “দেখো, আমার সোনার টুকরো ছেলে। রাস্তায় চলতে চলতেও বই পড়ে চলেছে।”

    তারপর এল হৃষ্টপুষ্ট নধর গড়ন এক ছেলে। সে তার মাকে বলল, “মা আমি কুস্তির আখড়ায় যাচ্ছি। ফিরতে দেরি হবে।” গর্বিত মা সব মায়েদের বললেন, “দেখো ভীমের মতো বলবান আমার এই ছেলে। একটুও বাড়িয়ে বলিনি।”

     বেলা অনেক হলো। চার মা’ই জলভরা কলসি তুলে নিয়েছেন, যে যার বাড়ি যাবেন। এমন সময় দূর থেকে একটি ছেলেকে ছুটতে ছুটতে আসতে দেখা গেল । এই ছেলের হাতে বই নেই, গলায় নেই কোকিলের মিষ্টি সুর, গায়ে নেই ভীমের মতো বল। বড়ো সাদামাটা ছেলে সে। 

    একজন মা বললেন, “ওই আসছে বোকাসোকা ছেলেটি। সাবিত্রী, এ তোমার ছেলে না?’” সাবিত্রী বলেন “হ্যাঁ”। একজন মা দুঃখ করে বলেন, “বেচারা সাবিত্রী, তোমার ছেলের কোন গুণই নেই।”

    সাবিত্রীর ছেলে শ্যাম মায়ের কাছে এসে বলল, “মা, তোমার কলসিটা আমাকে দাও। আমি এখন না এসে পড়লে তোমাকে এত ভারী কলসি বইতে হতো। আমি যখন ঠিক সময়ে এসে পড়েছি, তখন জলের কলসিটা আমিই নিয়ে যাব।”

      এই বলে জল-ভরা কলসিটা মাথায় তুলে নিয়ে শ্যাম হাসিমুখে গ্রামের দিকে হাঁটতে লাগল। অন্য মায়েদের ভাবনা–কিন্তু কে সেরা ছেলে, তার তো সঠিক বিচার হলো না! 

হঠাৎ তাদের নজরে পড়ল সেই বৃদ্ধ সাধুটি। কাছেই অশ্বত্থ গাছের তলে বসে আছেন তিনি। তাঁর সামনে এসে তিন মা বলেন, “সাধুবাবা, আপনি তো আমাদের চার ছেলেকেই দেখলেন। এখন দয়া করে বলুন কোন ছেলেটি সবার মধ্যে সেরা।”

      মিষ্টি হেসে বৃদ্ধ বললেন, “চারজন ছেলে! আমি তো মোটে একজনকেই দেখেছি। যে মায়ের হাত থেকে জল-ভরা কলসি তার মাথায় তুলে নিল। সেই এক মাতৃভক্ত ছেলেকে।”

     তিন মা থ! তাঁরা ভাবেন, একি  সাধু মহারাজ!  তাঁদের তিন গুণী ছেলের মধ্যে একজনও চোখে পড়ল না তাঁর?

     সাধু আবার বলেন, “হ্যাঁ, একটি ছেলেকেই আমি কেবল দেখেছি। কথা শুনেছি তার। মায়ের কষ্ট বুঝে সে ভারী কলসিটি মাথায় তুলে নিল। বাকি তিনটি তো ছেলে না। দোকানে সাজানো পুতুল। তাদেরও দেখেছি, কিন্তু ছেলে বলে চিনতে পারিনি।”

    তিন গর্বিত মায়ের বুঝতে বাকি রইল না চার ছেলের মধ্যে সত্যিকারের সেরা কে!

 


পাঠকদের মন্তব্য

কল্যাণ গঙ্গোপাধ্যায় লিখেছেন... ০৯ই সেপ্টেম্বর, ২০২৪
খুব সুন্দর, শিক্ষামূলক গল্প।
চৈতন্য দাশ লিখেছেন... ২১শে সেপ্টেম্বর, ২০২৪
ভীষণ ভালো গল্প
চৈতন্য দাশ লিখেছেন... ২১শে সেপ্টেম্বর, ২০২৪
ভীষণ ভালো গল্প

আপনি কি এই লেখায় আপনার মন্তব্য দিতে চান? তাহলে নিচে প্রদেয় ফর্মটিতে আপনার নাম, ই-মেইল ও আপনার মন্তব্য লিখে আমাদের পাঠিয়ে দিন।
নাম
ই-মেইল
মন্তব্য

250

    keyboard_arrow_up