ছোটোদের চাঁদের হাসি / দেশ-বিদেশের গপ্পো / অক্টোবর ২০২৫

কবি ও সূর্য

(ইরানের গল্প)

মূল লেখা : সাইরাস তাহবাজ

 

ছেলেটা সূর্যকে খুব ভালোবাসে। সে সূর্যকে শুধু দেখতে পায় তা নয়, সূর্যর সঙ্গে তার কথাও হয়, সূর্য তাকে গান শোনায়। ভোরের সূর্য ওঠার আগে মোরগের কোকর কো  শুনে শুরু হয় পাখিদের কিচিরমিচির, জেগে ওঠে গাছপালা, পশুপাখি সবাই। গাছের পাতার সবুজ রং, রঙবেরঙের ফুল, নীলাভ দীঘির জল–এ সবকিছুই সূর্যর অবদান। পাহাড়ের মাথায় যখন সূর্য ওঠে, নরম মিষ্টি আলোয় চারিদিক ভরে যায়। ছেলেটার বন্ধু সাদা খরগোশ নিজের বাসা থেকে বেরিয়ে ছুটতে থাকে পাহাড়ের দিকে। সেই কারণে সূর্য যখন অস্ত যায়, ছেলেটা মনমরা হয়ে থাকে। অন্ধকার ছেয়ে যায়, বাইরে, ঘরের ভেতরে। খরগোশ তার বাসায় ঢুকে পড়ে। মোরগের ডাক শোনা যায় না। শুধু পেঁচাদের কর্কশ ডাকে অন্য পাখিরা ভয় পেয়ে গান ভুলে বাসায় লুকিয়ে থাকে। চলে যাবার সময় সূর্য আলো, সুর এবং সমস্ত রঙ নিয়ে চলে যায় বলেই তো চারিদিক কালো হয়ে থাকে। ছেলেটা বিছানায় শুয়ে শুয়ে ভাবে কখন সকাল হবে। অন্ধকার তার একেবারেই পছন্দ নয়।

 

সেদিন সে বালিশে মাথা রেখে ভাবছিল, সূর্যকে কিভাবে কাছে ধরে রাখা যায়। ভাবতে ভাবতে ঘুমিয়ে পড়ল ছেলেটা। স্বপ্নে দেখল সে বড়ো হয়ে গেছে। সেদিনও মোরগের কোকর কো শুনে জেগে উঠল সবাই। ধীরে ধীরে অন্ধকার ফিকে হয়ে এলো। সে তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়লো। সে লক্ষ্য করেছে তাদের পাহাড়ি গ্রামের সবচেয়ে কাছের এবং বড়ো পাহাড়ের মাথায় সূর্যটা প্রথম ওঠে। ছেলেটাকে দ্রুত পায়ে চলতে দেখে অবাক হয়ে ছুটে এলো সাদা খরগোশ। ছেলেটার কাছাকাছি এসে জিজ্ঞেস করল, বন্ধু তুমি কোথায় যাচ্ছ?

ছেলেটা খুশি খুশি গলায় বলল, ওই পাহাড়ের মাথা থেকে সূর্যকে আনতে যাচ্ছি।

সাদা খরগোশ খুব অবাক হলো। ততক্ষণে সেখানে পৌঁছে গেছে লালঝুঁটি মোরগ। খরগোশ তাকে বলল ,দেখেছো, বন্ধু পাহাড়ের মাথায যাচ্ছে। ওকে আমাদের একা ছাড়া ঠিক নয়। চলো আমরাও ওর সঙ্গে যাই।

 

তারা তিনজন চলতে চলতে পৌঁছে গেল পাহাড়ের নিচে জঙ্গলের কাছে। সেখান থেকে ওপরে ওঠা শুরু। ছেলেটা চলেছে তার নিজের গতিতে, খরগোশ পাল্লা দিয়ে চলেছে লাফিয়ে লফিয়ে। আর মোরগ কখনও নাচতে নাচতে, কখনও উড়তে উড়তে তাদের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলার চেষ্টা করছে। ছেলেটা যত উঠছে তত অবাক হচ্ছে, কত সুন্দর গাছপালা, ঝোপঝাড়, লতাপাতায় সাজানো এই জঙ্গল। গাছের পাতার সবুজ রঙও কত রকমের ! রঙবেরঙের নানান ফুলে ছেয়ে আছে চারিদিক। ছেলেটা ভাবছিল, সে যত রকমের রঙ দেখেছে এবং চেনে তার চেয়েও অনেক বেশি রঙের বাহার এখানে। লাল, কমলা, হলুদ, বেগুনি কি রঙ নেই! চলার পথে পেরোতে হচ্ছে ছোট বড়ো নুড়ি-পাথর, কোথাও কোথাও ঝর্নার জলে ভেজা মাটি। চলতে চলতে লালঝুঁটি মোরগ ক্লান্ত হয়ে একটা পাথরের ওপর বসে বলল, আমি আর পারছি না, তোমরা যাও আমি এখানে তোমাদের অপেক্ষায় বসে থাকছি।

 

খরগোশের ক্লান্তি নেই। সে মহানন্দে চলল বন্ধুর সঙ্গে। ছেলেটা মুগ্ধ চোখে সব দেখতে দেখতে, চলতে চলতে হঠাৎ মনে হলো খুব দেরি হয়ে যাচ্ছে। সূর্য তো মাথার উপরে চলে যাবে। তখন আর ধরা যাবে না তাকে। সে দ্রুত পা চালিয়ে একসময় পাহাড়ের মাথায় পৌঁছে গেল।  সেখানে গাছপালা কম, ঘন লম্বা সবুজ ঘাস। সূর্য তখন পাহাড়ের মাথা ছাড়িয়ে অনেক ওপরে চলে গেছে। ছেলেটার খুব দুঃখ হলো। পাহাড়ের মাথায় দাঁড়িয়ে দেখল, তাদের গ্রাম ছাড়াও আরো অনেক গ্রাম দেখা যাচ্ছে। ওপর থেকে সাজানো খেলনা মনে হচ্ছে। সাদা খরগোশ ঘাস খাচ্ছে আর আনন্দে লাফাচ্ছে। ছেলেটা  বুঝতে পারল, সূর্য অনেক বড়ো। সূর্যকে হাতের মুঠোয় ধরা যায় না। মনের দুঃখে সে ঘাসের ওপরে দু চোখে হাত দিয়ে ঢেকে রেখে শুয়ে পড়লো।

 

হঠাৎ চোখ খুলতেই খেয়াল করল, আঙুলের ফাঁক দিয়ে সে গোল সূর্যকে পুরোপুরি দেখতে পাচ্ছে। খুশিতে আপ্লুত হয়ে গেল ছেলেটা। তার মনে খুব আনন্দ হলো এটা ভেবে, যেভাবেই হোক সে সূর্যকে ধরতে পেরেছে। সে স্পষ্ট শুনতে পেল–সূর্য তাকে বলছে,আমি সবসময় তোমাদের সঙ্গেই আছি। তোমাদের জন্যই এত আলো, এত সুর, এত রঙ সবকিছু নিয়ে প্রতিদিন আমি তোমাদের কাছে চলে আসি। গাছের পাতায়, পাখির গানে, আকাশ, বাতাস সব কিছুতেই আমাকে খুঁজে পাবে। ছেলেটা আনন্দে হাততালি দিয়ে উঠলো। খরগোশকে বলল, বন্ধু, সূর্য আমার সঙ্গে কথা বলেছে। চলো এবার ফিরে যাই।

দুজনে খুশিতে নাচতে নাচতে পাহাড় বেয়ে নামতে শুরু করল। লালঝুঁটি মোরগের কাছে এসে খরগোশ বলল, জান তো বন্ধুর সঙ্গে সূর্য কথা বলেছে।

 

সে কথা শুনে মোরগও আনন্দে নাচতে শুরু করল। কোকর কো করে সবাইকে সে কথা জানিয়ে দিল। একে একে পশুপাখি, গাছপালা সবার কাছে সে খবর পৌঁছে দিল বাতাস–সূর্য বন্ধুর সঙ্গে কথা বলেছে। নামতে নামতে ছেলেটা অবাক হয়ে দেখল, সবুজ ঘাস তার চলার পথ তৈরি করে দিচ্ছে। ডালপালা নাড়িয়ে গাছেরা অভিনন্দন জানাচ্ছে। পাখিরা মিষ্টি সুরে গান গাইছে। আনন্দে আত্মহারা হয়ে ছেলেটা প্রিয় বন্ধু সাদা খরগোশ আর মোরগের সঙ্গে বাড়ি ফিরে এলো। সে উপলব্ধি করল, গাছপালা, পশুপাখি, পাহাড়, ঝর্না সবার ভাষা সে বুঝতে পারছে। সে ঠিক করে নিল, এদের সবার মনের কথা কবিতায় লিখে সে মানুষের কাছে পৌঁছে দেবে।


পাঠকদের মন্তব্য

কোন মন্তব্য পাওয়া যায়নি

আপনি কি এই লেখায় আপনার মন্তব্য দিতে চান? তাহলে নিচে প্রদেয় ফর্মটিতে আপনার নাম, ই-মেইল ও আপনার মন্তব্য লিখে আমাদের পাঠিয়ে দিন।
নাম
ই-মেইল
মন্তব্য

250

    keyboard_arrow_up