ছোটোদের চাঁদের হাসি / দেশ-বিদেশের গপ্পো / নভেম্বর ২০২৩

কুৎসিত হাঁসের ছানা

গ্রামের দিকে মনোরম এক গ্রীষ্মের সকাল। হাঁসের মা পুকুরের ধারে তার বাসায় বসে ছিল। আসলে সে ডিমের ওপর বসে ডিমে তা দিচ্ছিল। বেশ কিছু সময় ধরেই মা-হাঁস ডিমে তা দিচ্ছিল বলে সে জানে, এবার ডিম ফুটে হাঁসের ছানা জন্ম নেবে।

শেষে এক সময় ডিমের খোসা ভেঙে হাসের ছানা চি-চি করে ডাকতে শুরু করে। কিন্তু মা-হাঁস দেখল, সব থেকে বড়ো ডিমটা তখনও খোসা ভেঙে ফোটেনি।

অবশেষে একদিন সেটা ফেটে ছানার জন্ম হলো। কিন্তু, সেই ছানাকে দেখে, মা হাঁসের মন খারাপ হয়ে গেল। কারণ, সব থেকে বড়ো ডিমটা থেকে যে ছানাটা বেরিয়ে এলো, তাকে খুব কুৎসিৎ দেখতে। অন্য ছানাদের মতো সে হলদে আর নরম তুলতুলে নয়।

মা-হাঁসের মনে হলো এই বড়ো ডিমের ছানাটা হয়তো তার নিজের ডিম নয়। তবু সে অন্য ছানাদের মতো ভালোবেসে, তাকেও সবার সঙ্গে পুকুরে সাঁতার দিতে নিয়ে গেলো। ছানাটাকে অন্যদের থেকে আলাদা দেখতে হলেও সে অন্যদের সঙ্গে খুব চেষ্টা আর পরিশ্রম করে সাঁতার কাটতে শিখে নিল। মা-হাঁস ভাবলো, একটু বড়ো হয়ে উঠলে সেও তার ভাই-বোনদের মতোই দেখতে হবে।

 

সময় কাটতে লাগল। ছানাটা বড়ো হয়ে উঠলেও, তার ডানার পালক হলুদ রঙের হলো না। অন্য পশুরা তাই নিয়ে তাকে ঠাট্টা করতো বলে, সে সকলের থেকে আলাদা থাকতো। এমন কি টার্কি পাখিও তাকে দেখে মুখে গরগর আওয়াজ করত বিরক্তিতে।

শেষে মা-হাঁস ঠিক করলো, এই অদ্ভুত ছানাটাকে বুনো হাঁসদের দলে পাঠিয়ে দেবে। ছানাটাও ব্যাপারটা বুঝতে পেরে আর আপত্তি করল না।

অদ্ভুত ছানাটা বনের মধ্যে ঘুরে বেড়ায়। অন্ধকার বন বেশ ঠান্ডা। সে সেখানে একলা কাটায় ভয়ে ভয়ে।

একটা খরগোশ লাফাতে লাফাতে তার সামনে দিয়ে বাসায় যায়। অন্য অচেনা জন্তদের দেখে সে খুব ভয় পায়। গাছেরা, ফুলেরাও সব আলাদা ধরনের আর রাতের বেলা কেমন যেন খস খস আওয়াজ শোনা যায়। শেষ পর্যন্ত সে একটা জলায় পৌঁছোয়। কিন্তু বুনো হাঁসরাও তার সঙ্গে ভালো ব্যবহার করে না।

কদাকার হাঁসের ছানাটা লম্বা ঘাসের মধ্যে লুকিয়ে থেকে, চারপাশে দেখতে থাকে। শিকারিরা বন্দুক হাতে আর ঘেউ ঘেউ করতে থাকা কুকুরগুলো জলায় ঘুরে বেড়ায়। সে আরও বেশি করে ভয় পায়।

যতক্ষণ না শিকারিরা চলে যায় ছানাটি চুপ করে আড়ালে থাকে। তারপর জলা থেকে দূরে মাঠ আর উপত্যকা ছেড়ে ছুটে অন্য দিকে পালায়। কিন্তু তখনও তার ভয় কাটে না।

 

এরপর জঙ্গলের ধারে এক ছোট কুঁড়েঘরে এসে পৌঁছোয় সে। এক বুড়ি মহিলা তার বেড়াল আর মুরগি নিয়ে থাকে কুঁড়েতে। বিকেলে তারা আগুনের ধারে বসে থাকে। তারা কুৎসিৎ হাঁসের ছানাকে তাদের সঙ্গে থাকতে দেয়। কিন্তু তারা দেখে, কুৎসিৎ হাঁসের ছানা কোনো ডিম পাড়ে না এবং ঘরের কাজও করতে চায় না। তখন তারা তাকে ভাগিয়ে দেয়। ফলে আবার সে একা হয়ে পথে বেরোয়।

শীতের চরম ঠান্ডায় চারিদিকে তুষারপাত হয় আর হৃদের জল জমে যায়। ঠান্ডায় আর কোনও খাবার না পেয়ে বেচারা কুৎসিত ছানাটা মরতে বসে। সে সময়ে এক কৃষক তাকে হ্রদের ধারে শীতে কাঁপতে দেখে যত্ন করে তুলে নিয়ে ঘরে আসে। কৃষক ভেবেছিল তার ছেলেমেয়েরা বেচারা হাঁসের ছানাকে ঘরে রাখবে আর খেতেও দেবে।

তাদের বাবা বাড়ি ফিরে আসতে ছেলেমেয়েরা খুব খুশি। হাঁসের ছানাটা ভেবেছিল, তাকে দেখতে কদাকার বলে ছেলেমেয়েরা তাকে নিয়ে ঠাট্টা তামাশা করবে। সে বাচ্চাদের কাছ থেকে লুকিয়ে থাকতে চেষ্টা করে। সে সব সময় আতঙ্কে আর আশঙ্কায় দিন কাটায়। একদিন সে তাদের হাত থেকে পালিয়ে কোনো নিরাপদ কোণে লুকিয়ে পড়ে।

 

অবশেষে বসন্ত ঋতু আসে। বাতাস চমৎকার উষ্ণ হয়ে ওঠে। বাগানের ঘাস বড়ো হয় আর চারপাশের মাঠে ফুল ফোটে। কুৎসিৎ হাঁসের ছানা একটা হ্রদের কাছে আসে। সে দেখে লেকের জলে বড়ো সাদা রঙের লম্বা গলা রাজহাঁসেরা সাঁতার কাটছে। নিজের কদাকার চেহারার জন্য কুষ্ঠার সঙ্গে সে তাদের পিছনে পিছনে যেতে থাকে। সবচেয়ে বড়ো রাজহাঁসটা তাকে জিজ্ঞেস করে, তুমি এত দুখী হয়ে আছো কেন?

মাথা নিচু করে কুৎসিত ছানাটা বলে, আমি কুৎসিত বলে কেউ আমাকে ভালোবাসে না।

রাজহাঁস বলল, সেকি কথা? কে বলে তুমি কুৎসিত?

তোমার এত মিষ্টি ব্যবহার, নম্র স্বভাব! মনে রেখো, চেহারা নয়, স্বভাবই সকলের আসল পরিচয়। তুমি আমাদের সঙ্গে থাকো। কেউ তোমার সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করবে না।

একথা শুনে হাঁসের ছানার মন খুশিতে ভরে যায়। সে রাজঁহাসদের সঙ্গে সাঁতার কাটে, খেলা করে। এখন সে আর একা নয়।


পাঠকদের মন্তব্য

কোন মন্তব্য পাওয়া যায়নি

আপনি কি এই লেখায় আপনার মন্তব্য দিতে চান? তাহলে নিচে প্রদেয় ফর্মটিতে আপনার নাম, ই-মেইল ও আপনার মন্তব্য লিখে আমাদের পাঠিয়ে দিন।
নাম
ই-মেইল
মন্তব্য

250

    keyboard_arrow_up