রাজদর্শন
অসিত দত্ত
(ব্রহ্মদেশের লোককথা)
বার্মা মুলুকের সমুদ্দুরের ধারের এক গ্রামে এক শান্তশিষ্ট ভালোমানুষ বাস করত। কিন্তু সে ছিল খুব গরীব। গরীব হলে কী হয়, তার একটা ঘোড়ারোগ ছিল। মানে ঘোরাঘুরির রোগ। ঘোড়াফোড়া তার ছিল না। তাই পায়ে হেঁটেই এদিক-সেদিক, যেদিকে দু'চোখ যায় বেরিয়ে পড়ত। তার গাঁয়ের মাইলের-পর-মাইল সাগর পারাবার দেখতে দেখতে যখন একঘেয়ে লেগে যেত, তখন পায়ে হেঁটেই ভ্রমণে বেরিয়ে যেত।
নতুন দেশের ভালো ভালো জায়গা দেখে বেড়ানোর খুব সখ ছিল তার। হলে কী হয়, তার টাকাকড়ি তো বেশি নেই। তাই মাঝে মাঝে মনটা খুবই খারাপ হতো বেচারার। তার মনে আরো একটা ইচ্ছে খুবই প্রবল ছিল। বেড়াতে বেড়াতে যদি কোনোদিন একবার রাজদর্শন করে ধন্য হতে পারে সে। আবার ভাবত, সেই রকম সৌভাগ্য কী তার কোনোদিন হবে?
শেষে সে নিজে নিজেই একটা উপায় বার করল। দু-চার পয়সা করে জমাতে জমাতে যখন বেশ দু-চার টাকা জমল, তখন তাই সম্বল করে লোটাকম্বল নিয়ে বেরিয়ে পড়ল সে। পোটলাপুটলি, হাঁড়িকুড়ি বেঁধে নিয়ে পথে নামল মানুষটি। যাচ্ছে তো যাচ্ছেই, হাঁটছে তো হাঁটছেই। এমনি করে অনেকটা পথ পার হবার পর তার খুব খিদে পেয়ে গেল। আশপাশে খাবারের দোকান-টোকান অনেক আছে। কিন্তু সেখানে ঢুকে পয়সা দিয়ে কিনে খাবার খাওয়ার উপায় নেই তার। সে বাড়ি থেকে আনা হাঁড়ি ভরতি করে ভাত, আলুভাতে আর উচ্ছে সেদ্ধ করে রাখে। তাই খেয়ে দু-তিনদিন যা চলে। আবার দরকার মতো বসে বসে খাবে বলে ভাতে ভাত ফুটিয়ে নেয়।
এদিকে হয়েছে কী, যেখানটায় বসে বসে আমাদের এই পথিকবাবু ভাত খাচ্ছিল, তার ঠিক উল্টো দিকেই একটা খাবারের দোকানঘর ছিল। সেখানে দোকানি খুব করে মাছ ভাজছিল আর বিক্রি করছিল। মাছ ভাজার খুব সুন্দর গন্ধে চারদিকের বাতাস ভুর ভুর করছিল। দোকানিটা বসে বসে পথিকবাবুর ভাত খাওয়া দেখছিল আর ভাবছিল, লোকটা অতটা ভাত শুধু আলুভাতে আর উচ্ছে সেদ্ধ দিয়ে কী করে খেল? নিশ্চয়ই কোনো রহস্য আছে। আমার দোকানের মাছ ভাজার গন্ধ দিয়েই নিশ্চয়ই সে অতটা ভাত খেয়ে ফেলল। গন্ধচোর কোথাকার !!
এদিকে খাওয়া-দাওয়া সেরে জিনিসপত্র গুছিয়ে পথিকবাবু তো আবার হাঁটা দেবার উদ্যোগ করছে। এমন সময়ে মাছ ভাজার দোকানিটা গিয়ে তাকে খপ করে ধরল।
–এই যে বাছাধন। চললে কোথায়? আমার পয়সাটা দিয়ে যাও।
পথিকবাবু তো অবাক। তার তো আকাশ থেকে পড়ার মতন অবস্থা। সে তো ওই লোকটার দোকান থেকে কিছু কিনে খায়নি। তবে আবার পয়সা কিসের ?
–কিসের পয়সা? আমি তো তোমার দোকান থেকে কিছু কিনে খাইনি?
দোকানি তখন বলল, কিনে খাওনি মানে? এতক্ষণ যে বসে বসে অতটা ভাত গিললে, সে কি শুধু উচ্ছে আর আলুভাতে দিয়ে? আমার দোকান থেকে যে মাছ ভাজার গন্ধ বের হচ্ছে–তাই দিয়ে তুমি অতটা ভাত খেয়েছ। দাও দাও পয়সা দাও। গন্ধ খাওয়ার পয়সা দাও। নইলে আর তোমার নিস্তার নেই।
এই করে তো কথায় কথায় দু'জনের খুব জোর তর্কাতর্কি, ঝগড়াঝাটি বেঁধে গেল। কথা কাটাকাটিতে আশপাশের লোক জড়ো হয়ে গেল। মাছ ভাজা খেতে যারা দোকানে এসেছিল, তারাও জুটে গেল। দোকানির গলার জোর আরো বেড়ে গেল। দোকানি কিছুতেই ছাড়বে না, পথিকবাবুও পয়সা দেবে না। কিছুতেই ফয়সালা হয় না। কেউ কিছু সমাধানের পথও বাতলাতে পারে না।পথিকবাবু ভাবতে লাগল, আমি নিরীহ গোবেচারা মানুষ। কারোর সাতে-পাঁচে নেই। আমার ওপরে কেন এত হ্যাপা। ভগবান এই কী তোমার বিচার?
শেষে সব লোকেরা বলল, অত কথায় কাজ নেই। দিনের আলো থাকতে থাকতে তোমরা বাপু রাজামশারের কাছে যাও। তিনি তো এখন রাজসভাতেই বসে আছেন। তিনি বিচার করে যা বলবেন, তোমরা তা-ই মেনে নেবে।
তখন তাই ঠিক হল। সবাই মিলে মজা দেখতে রাজাবাবুর দরবারে এসে হাজির।
রাজামশাই তখন মন্ত্রী, সান্ত্রী আর যন্ত্রীদের নিয়ে জাঁকিয়ে রাজকার্য পরিচালনা করছিলেন। এমন সময় দোকানি তার লোকজন নিয়ে এসে হাজির। কী ব্যাপার? মন্ত্রীমশাই জিজ্ঞেস করলেন। সভায় হাজির হয়েই পাজি দোকানিটা চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে বলতে লাগল, দেখুন না রাজামশাই, এই উটকো লোকটা আমার দোকানের মাছভাজার গন্ধ চুরি করে ভাত খেয়েছে। আর এখন তার দাম না দিয়ে পালাতে চাইছে।
পথিকবাবু শান্ত গলায় হাতজোড় করে মিনতি করে বলল, আজ্ঞে না রাজাবাবু, আমি ওনার মাছের গন্ধ চুরি করতে যাবো কেন? আমি তো শুধু আমার নিজের উচ্ছে-আলুসেদ্ধ দিয়ে মেখে ভাত খেয়েছি। আমি গরীব মানুষ হুজুর। মাছ ভাজার গন্ধ কেনার পয়সা কোথায় পাবো?
কথাগুলো কোনোমতে বলে ফেলেই পথিকবাবু করুণ অপলক দৃষ্টিতে রাজমশাইয়ের দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখতে লাগল।
এদিকে দুইপক্ষের কথা শুনতে শুনতে রাজাবাবু মুচকি মুচকি হাসছিলেন আর ভাবছিলেন, এই ব্যাটা শয়তান দোকানিটাকে কীভাবে জব্দ করা যায়। ওই গন্ধের কথাতেই সন্দেহ হল রাজাবাবুর। বুঝলেন, এই নিরীহ প্রজাটিকে দুষ্টু দোকানিটা খুব ঠকাতে চাইছে। গালে হাত দিয়ে খুব চিন্তাভাবনা করে বললেন, তাই তো হে বাপু! এ তো বড়ো অন্যায় কথা। তুমি এই দোকানির মাছভাজার গন্ধ চুরি করে ভাত খেয়েছ, তোমাকে তো তার দাম চুকিয়ে দিতেই হবে।
পথিকবাবু ভাবছিল, এ তো বড়ো অন্যায় বিচার। রাজার সাথে তার এইভাবে দেখা হবে, সে তা স্বপ্নেও ভাবেনি।
আর দোকানি ব্যাটা ভাবছিল, যাক বাবা, মুফতে এই বোকা লোকটার কাছ থেকে কিছু টাকা হাতানো যাবে।
রাজাবাবু দোকানিকে জিজ্ঞেস করলেন, তা বাপু হে, তোমার মাছভাজার দাম কত?
–হুজুর বেশ বড়োসড়ো মাছ ভাজা। দু'টাকা দাম হবে একটার। রাজামশাই বললেন, কী হে পথিক, তোমার কাছে আছে তো টাকা?
পথিকবাবু ভাবল, কী আর করা যাবে, তার কাছে যে সামান্য টাকা আছে, রাজার বিচারে তাও গচ্চা যাবে। সে তখন কাচুমাচু হয়ে বলল, হ্যাঁ রাজাবাবু, আমার কাছে কয়েকটা টাকার মুদ্রা আছে। রাজামশাই বললেন, বেশ বেশ, তাতেই হবে। তুমি একটা টাকা হাতে করে ধরে আমার উঠোনে গিয়ে তোমার টাকার ছায়াটা এই দোকানিকে দেখাও, তাহলেই ওর দাম পাওয়া হয়ে যাবে। শোনো হে দোকানি, তোমার মতো অসৎ লোকের এটাই জব্দ করার শাস্তি। ও তোমার মাছ ভাজার গন্ধ খেয়েছে, আর তুমি ওর টাকার ছায়াটা দেখে নিয়েছ। ব্যাস, শোধবোধ হয়ে গেল। তোমার এটাই পাওনা। এবার তুমি বিদেয় হও।
সঙ্গের লোকজন সবাই মজা করে হাসতে হাসতে যে যার বাড়ি চলে গেল। দোকানিটা বোকা বনে ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রইল।
পথিকবাবু রাজামশাইয়ের দিকে চেয়ে মুগ্ধ চোখে দেখতে দেখতে 'পেন্নাম হই রাজাবাবু' বলে তার বাড়ির দিকে হাঁটা দিল। আর মনে মনে ভাবতে লাগল, এতদিনে রাজদর্শন সার্থক হল তার।
পাঠকদের মন্তব্য
250