ছোটোদের চাঁদের হাসি / দেশ-বিদেশের গপ্পো / জুলাই ২০২৫

এক যে ছিল

(রোমানিয়া)

 

এক যে ছিল পুষি বেড়াল, তার ছিল নরম লোমে ঢাকা বিশাল লম্বা এক লেজ। লোমগুলি ধীরে ধীরে যখন  বেশ বড় হলো, তখন সে গেল এক নাপিতের কাছে, তার লোম ছাঁটাই করতে। যেমন আমরা লোম ছাঁটাই করি আর কি! চালাক নাপিত ভাবল, বাবা, এত লোম ছাঁটতে গেলে তো অনেক সময় লেগে যাবে, আর খাটুনি হবে খুব। তাই সে পুষিকে বলল, দেখো ভাই, তোমার লেজটা বেশ লম্বা–তোমার চেহারায় ঠিক মানায় না। তুমি বরং এটাকে একটু ছোট করে নাও। তাহলে তোমায় দেখতে খুবই সুন্দর হবে।

        পুষি বেড়ালের বয়স কম, আর বুদ্ধিতেও তেমন পাক ধরেনি। চালাক নাপিতের মন ভোলানো কথা তার মনে ধরল। সে নাপিতকে বলল, তুমি বেশ বুঝদার মানুষ। লেজটা ছোট হলে যদি সুন্দর হয় তবে তা কেটে দিও।

           নাপিত চকচকে খুরটায় আরেকটু শান দিয়ে ঘষে তার ধার বাড়িয়ে টুক করে ল্যাজটা কেটে ছোট করে দিল। আর পুষির মন খুশিতে ভরিয়ে বাড়তি কিছু পয়সাও আদায় করে নিল।

 

           পথে বেরিয়ে হাঁটতে পুষির মন ভরে গেল, আঃ কি হালকা লাগছে শরীরটা। আর নিশ্চয় খুব সুন্দর দেখাচ্ছে আমাকে। ভাবতে ভাবতে হঠাৎই তার মনে একটা খটকা দেখা দিল। তাই তো নাপিতটা তার কাটা লেজটা রেখে দিল কেন? নিশ্চয়ই তার কোনও মতলব আছে। ওর কাছে বরং কাটা লেজটা চেয়ে আনি গে। যেমন ভাবা, তেমনি কাজ। তখুনি ফিরে এসে নাপিতের কাছে সেই কাটা লেজখানা ফেরৎ চাইল পুষি। ততক্ষণে নাপিত অন্যান্য নোংরা জিনিসের সঙ্গে লেজখানাও ফেলে দিয়েছে। সে বলল, বারে, তখন চাইলে আমি তা দিয়ে দিতাম। এখন আমি তা কোথায় পাব? চুল কাটাতে এসে কেউ কি তা ফেরত চায় ?

         পুষি তা শুনবে কেন? সে বলল, হয় আমার লেজ দাও, নইলে এই খুরটা নিলাম, বলেই খুর  নিয়ে সে ছুট লাগাল। নাপিত তার নাগাল পেল না।

 

          পথে যেতে পুষি দেখে একটা গরিব মেয়ে ছোট পাত্রে কটা মাছ নিয়ে যাচ্ছে। অথচ মাছ কাটবার মত কোন ছুরি তার কাছে নেই। তা দেখে পুষির মনে ভারী কষ্ট হলো। সে নাপিতের সেই খুরখানা মেয়েটির দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, মনে হচ্ছে এমন ছুরি তোমার কাছে নেই। আমার কাছে এই খুর রয়েছে। এটা আমার কোন কাজে লাগছে না। এটা তুমি নাও। মেয়েটি খুর পেয়ে ভারী খুশি হলো। বলল, আপনি আমার কী যে উপকার করলেন। সত্যি আমাদের কোন খুর নেই।   

        ক’পা হেঁটে পুষির মনে হল, মেয়েটা ভারী অভদ্র। ওর কি উচিত ছিল না খুরের বদলে ওকে অন্তত একটা মাছ দেওয়া? সে এবারে মেয়েটার কাছে একটি মাছ দাবি করল। মেয়েটি বলল তা তো হবে না, আমাদের বাড়ির সবার জন্য একটা করে মাছই যে এনেছি। এর থেকে কিছু দেওয়া যাবে না। তবে রে…বলে পুষি মেয়েটার পাত্র থেকে একটা মাছ তুলে নিয়ে ছুট লাগাল।

 

         চলতে চলতে সে এসে পৌঁছল একটা যাঁতাকলের কাছে। এই কলের ছেলেটি বাইরে বারান্দায় বসে ক’খানা শুকনো রুটি খাচ্ছিল। তা দেখে পুষির খুব কষ্ট হলো। সে তাড়াতাড়ি ছেলেটির কাছে গিয়ে বলল, শুকনো রুটি খেতে তোমার খুব কষ্ট হচ্ছে না? এই মাছটা তো আমার কোন কাজে লাগছে না। তুমি বরং এটা পুড়িয়ে নিয়ে রুটি কটা খাও। মাছ পেয়ে ছেলেটা ভেতরের উনুনে পুড়িয়ে নুন মাখিয়ে রুটি ক’টা তৃপ্তি ভরে খেল। তখনি পুষির মনে হলো, এ মাছ ওকে না দিয়ে নিজেই তো খেতে পারত।  যাই, মাছটি ফেরৎ নিয়ে আমি। ততক্ষণে ছেলেটির খাওয়ার পালা শেষ হয়ে গেছে। ছেলেটি খাওয়া শেষ করে মুখ মুছে বসে ছিল। মাছ ফেরৎ দেবে কী করে? সে দিতে পারল না। পুষি বলল তবে আমায় ময়দার একটা বস্তা দাও–বলে একটা ময়দা বোঝাই বস্তা নিয়ে চলল।

 

           পুষি এবার এসে পড়ল একটা স্কুলের সামনে। স্কুলের দিদিমণি বাচ্চা ছাত্রদের নিয়ে শুকনো মুখে দাঁড়িয়ে ছিলেন। তা দেখে পুষির মনে ভারী কষ্ট হলো। সে ময়দার বস্তাটা ওদের হাতে দিয়ে বলল, বোধ হয় আপনাদের এখনো কোন খাওয়া জোটেনি।  আপনারা বরং এই বস্তাটা রাখুন। ময়দার  বস্তা পেয়ে বাচ্চারা এমনকি দিদিমনিও ভারী খুশি। পুষিকে তারা অনেক ধন্যবাদ দিল। অনেকদিন বাদে ওরা পেট ভরে খেতে পেল। এদিকে পথ চলতে চলতে হঠাৎই পুষির মনে হল, এরা তো ভালো লোক নয়, আমাকেও তো খানকয়েক রুটি দিতে পারত। ভেবে সে আবার  ওদের কাছে ফিরে এসে ক’খানা রুটি চাইল। ততক্ষণে ওরা সব ময়দাই রুটি বানিয়ে খেয়ে ফেলেছে। তাই তারা তাকে রুটি  দিতে পারল না। তখন পুষি বলল, যদি রুটি দিতে না পারেন, তবে একটা বাচ্চাকে  দিতে হবে। বলেই সে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে একটা বাচ্চা নিয়ে ছুট লাগাল।

 

            চলতে চলতে সে একটা ধোবাখানার সামনে এসে পড়ল। বাচ্চাটাকে নিয়ে চলতে পুষির বেশ কষ্ট হচ্ছিল। ধোবাখানার বুড়ির কাছে বাচ্চাটাকে দিয়ে বলল, বুড়িমা, এই মেয়েটাকে রাখো। এ তোমার সব কাজ  করে দেবে। বুড়ি একা একা সব কাজ আর করে উঠতে পারে না।  একটা মেয়ে পেয়ে সত্যিই ভালো হলো তার। পুষিকে সে অনেক ধন্যবাদ জানাল। তারপরে হাঁটতে হাঁটতে  অনেকটা পথ পেরিয়ে এসে পুষির মনে হলো, আচ্ছা বুড়িটাকে একটা মেয়ে দিলাম,ওর কি আমায় একটা শার্ট দেওয়া উচিত ছিল না?

           তাই সে এসে বুড়ির কাছে একটা শার্ট চাইল, আর বুড়ি কিছু দেবার আগেই একখানা শার্ট কেড়ে নিয়ে ছুট  লাগাল। শার্ট নিয়ে চলতে পুষির বেশ কষ্ট হচ্ছিল। এমন সময় তার দেখা এক বেহালাওলার সঙ্গে। হাটের দিক থেকে লোকটা আসছিল। তার পরনে ছিল ময়লা কাপড়, অথচ কোন শার্টই  ছিল না। তা দেখে পুষির বড় কষ্ট হলো। সে বলল, বাপু, তোমার তো দেখছি কোন শার্টই নেই, তুমি বরং এই শার্টটা নাও, তোমার কাজে লাগবে।

          শার্ট পেয়ে লোকটা ভারী খুশি হল। সে বেহালাটা পাশে নামিয়ে শার্টটা পরে দেখতে লাগল–তাকে কেমন মানিয়েছে। লোকটা মন দিয়ে তা দেখছে, আর এই ফাঁকে পুষি তার বেহালাখানা  নিয়ে ছুট লাগাল।

          অবশ্য লোকটা যে খুব বেহালা বাজাত তা নয়। তাই বেহালা হারিয়ে বেশি কষ্ট হলো না তার। বরং দামি শার্ট গায়ে তাকে বেশ লাগছিল। তার দৌলতে সে একটা চাকরি জুটিয়ে নিল। তার একটা হিল্লে হলা। অনেক টাকা রোজগার করল। এক বড়লোকের সুন্দরী মেয়ের সঙ্গে বিয়েও হল তার।

 

             সকাল থেকে অনেক খাটাখাটনি হয়েছে, আর খিদেও পেয়েছে। গ্রামের সরাইখানার সামনে দাঁড়িয়ে পুষি তার হাতে ধরা বেহালাটা বাজাতে লাগল।

             বেড়ালকে এমন মজার ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে মজার সুরে বেহালা বাজাতে দেখে অনেক লোক জমে গেল।   তাদের ছুঁড়ে দেওয়া টাকায় পুষির টুপি ভরে গেল। এতে ভারী খুশি হলো সে। মনে মনে ভাবল, এবার ওস্তাদের কাছে বেহালা বাজাতে শিখবে। এক উস্তাদ বেহালা বাদকের কাছে সে তালিম নিল। এর পরে তার নামডাক চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ল। মাঝে মাঝে উৎসব বাড়িতে, এমনকি বড়ো বড়ো অনুষ্ঠান থেকেও ডাক পড়লো তার। ভারী খুশিতে জীবন কাটাল সেই পুষি।


পাঠকদের মন্তব্য

তনুজা চক্রবর্তী লিখেছেন... ১৪ই জুলাই, ২০২৫
আজগুবি ভাবনার বেশ মজার লেখা।

আপনি কি এই লেখায় আপনার মন্তব্য দিতে চান? তাহলে নিচে প্রদেয় ফর্মটিতে আপনার নাম, ই-মেইল ও আপনার মন্তব্য লিখে আমাদের পাঠিয়ে দিন।
নাম
ই-মেইল
মন্তব্য

250

    keyboard_arrow_up