এক উট ও এক শেয়াল
অরুণ চট্টোপাধ্যায়
(সোমালি উপকথা)
এক উট ছিল৷ সে চাষির ক্ষেতে চুপি চুপি গিয়ে শাকসবজি খেত ৷ আর ছিল এক শেয়াল ৷ সে-ও ছিল খুব ধূর্ত, নিরীহ লোকের খামারে গিয়ে মুরগির ছানা চুরি করে গবগব করে গিলে খায়৷ এ কাজে তার জুড়ি মেলা ভার।
উট আর শেয়াল–দুজনেই চুরি করে খায়৷ চোরে-চোরে মাসতুতো ভাই যেন এরা৷ তাই দুজনের খুব ভাব, ওরা সত্যিকারের বন্ধুও বটে৷
এক দিন উট বলল, “এখানে তো আর খাবার নেই দেখছি বন্ধু৷ চলো এই নদীটা পেরিয়ে গেলে আমরা পেয়ে যাব মস্ত একটা ক্ষেত ও খামার৷”
নদীর একগলা জলের দিকে তাকিয়ে শেয়াল বলল, “হায় বন্ধু ওপারে যেতে গেলে আমি যে ভেসে যাব নদীর স্রোতে৷”
ফ্যাচ্ করে হেসে দিল উট, “এই তোমার বুদ্ধি! আমার পিঠে উঠে পড়ো, তারপর দুজনে সহজেই নদী পেরিয়ে যাব৷”
শেয়ালের বুদ্ধির খুব নামডাক, এমন বোকার মতো কথা বলে সে খুব লজ্জা পেল। একটুও সময় নষ্ট না করে সে তিড়িং করে লাফিয়ে উঠে বসল উটের পিঠে৷
উট দুলকি চালে নদী পেরিয়ে অন্য তীরে যেতেই, শেয়াল এক লাফে নেমে পড়ল ভূমিতে৷ তারপর এক ছুটে মুরগির খামারে ঢুকে কয়েকটা ছানা খেয়ে ফেলল৷
আর উট ? সে মনের আনন্দে ক্ষেতের শাকসবজি
গোগ্রাসে গিলতে লাগল৷
শেয়াল তাড়াতাড়ি খেয়েদেয়ে একটা ঢেকুর তুলল–আঃ কী দারুণ ভোজটাই না হল আজ৷ পেট আইঢাই, মনে পুলক উপচে পড়ছে যেন৷
উটের কাছে গিয়ে বলল সে, “আমার ভাই আজ খুব ফুর্তি হয়েছে৷ তুমি তো জান, পেট পুরে খেয়েদেয়ে ফুর্তি হলে খুব গান গাইতে ইচ্ছে করে আমার৷” উট ব্যস্ত হয়ে বলল, “আরে ভাই, আমার এই জালার মত পেট ভরতে এখনো অনেক বাকি। তুমি এখনই গান ধরলে, চাষিরা ছুটে আসবে। আমাদের খুব বিপদ হবে৷ আগে আমার খাওয়া শেষ হোক, তারপর না হয়…৷”
কে কার কথা শোনে? শিয়াল চিৎকার করে ‘হুক্কা হুয়া, ক্যা হুয়া… য়়া…য়া…’ খুব জোরে গান ধরল৷
“কে রে কেরে… কে এসেছে চুরি করতে”–বলতে বলতে চাষিরা লাঠিসোটা নিয়ে তেড়ে এল৷
শিয়াল গান থামিয়ে দে দৌড়…৷
আর কিছু বুঝে ওঠার আগেই চাষিরা উটের পিঠে-গায়ে ঘা- কতক লাঠির বাড়ি বসিয়ে দিল। সে কোনোক্রমে মার খেতে খেতে ছুটে নদীর তীরে এলো৷ এসে দেখল কাঁচুমাচু মুখ করে শিয়াল সেখানে বসে আছে৷
উটকে দেখে শেয়াল বলল, “খুব ভুল হয়ে গেছে বন্ধু, আর কখনো এমন হবে না৷”
শেয়ালের কথায় চিঁড়ে ভিজল না, উট মনের ভাব গোপন করে বলল, “ঠিক আছে, আমার পিঠে উঠে বসো৷”
তখনই লাফয়ে উটের পিঠে গিয়ে বসল শেয়াল৷
নদীর মাঝখানে এসে উট থমকে দাঁড়াল৷ সেখানে গভীর জল৷ এবার উট বলল, “তা ভাই এটাও তো তুমি জান, খেয়েদেয়ে পেট জয়ঢাক হলে আমি স্নান না করে থাকতে পারিনা ৷”
শিয়াল বিপদ বুঝে অনুনয় করে বলল, “না ভাই, এখন তুমি গলাজলে ডুব দিয়ে স্নান করলে আমি যে ভেসে যাব, আমি তো সাঁতার জানিনা…।”
“আমি দুঃখিত বন্ধু”, বলল উট, “আমি ভোজনের পর সব সময় গলা-সমান জলে ডুব দিয়ে স্নান করি৷”
একথা বলতে বলতে উট ধীরে ধীরে তার পেট, তার কাঁধ জলের নিচে ডুবিয়ে দিতে লাগল…।
“আমাকে দয়া করো…আমাকে বাঁচাও…” চিৎকার করতে লাগল শেয়াল।
“তাহলে এবার বলো তো, তুমি গান গেয়ে যা করেছ তার জন্য কি দুঃখিত?”
“হ্যাঁ বন্ধু, আমি খুব দুঃখিত, লজ্জাও পেয়েছি খুব” শেয়াল বলল৷
শেয়ালের কথায় উটের মন গলে গেল৷ সে কখনোই চায় না শেয়াল জলে ডুবে যাক৷ তাই সে আবার সোজা হয়ে দাঁড়াল মাঝ-নদীতে। তারপর তীরে এসে গা-ঝাড়া দিলো৷
শেয়াল লাফিয়ে মাটিতে নেমে বলল, “এই আমি শপথ করছি, আর কোনদিন এমন কাজ করব না৷”
উট বলল, “আমিও শপথ করছি, তোমার কোনো অনিষ্ট করবো না। যা আমি করেছি, তা তোমাকে শিক্ষা দিতে…
যাকে বলে, যেমন কুকুর, তার তেমনি মুগুর আর কি !!”
দুজনেই হো হো করে হেসে উঠল৷
পাঠকদের মন্তব্য
250