বাঘ রাজার আবেদন
মহিবুল্লা কাফি (বাংলাদেশ)
আমি বাঘ। বনের রাজা বাঘ। তোমাদের সুন্দরবন নামে যে বিশাল বনটা আছে না, ওখানে আমার বসবাস। ওটাই আমার রাজ্য। আমি ওই বনের রাজা।
যদিও আগের মতো বন নেই–এখন নেই তেমন গাছগাছড়া। মানুষ বড়ো গাছ কেটে নিয়ে যাচ্ছে। অবাধে পশুপাখি হত্যা করছে। নেই আগের মত পশুপাখি। ক্রমান্বয়ে সবকিছু বিলীন হয়ে যাচ্ছে। দিন দিন সুন্দরবন সৌন্দর্য হারাচ্ছে।
যাকগে সে কথা, কাজের কথায় আসি।
আজ আমি এসেছি আমার রাজ্যের প্রজাদের কিছু অভিযোগ নিয়ে।
তাদের দুঃখ-বেদনা, হতাশা ও অব্যক্ত কিছু কথা নিয়ে। যা আজ আমি তোমাদের শোনাবো।
আমি প্রতি পাঁচ মাস পরপর আমার রাজ্য সুন্দরবনে মিলনমেলা বা ভোজসভার আয়োজন করে থাকি। সেই সভায় সুন্দরবনের সব পশুপাখিরা একত্রিত হয়। এ ওর সাথে সাক্ষাৎ করে। কুশল বিনিময় করে। মেতে ওঠে গালগল্পে।
এরপর বিশাল ভোজ। আশ মিটিয়ে ভোজন করে আমার সব প্রজাতির প্রজারা। ভোজন শেষে বসি আমি আমার সিংহাসনে। এক এক করে সবাই যে যার অভিযোগ উপস্থাপন করে। আমি মনোযোগী হয়ে শুনি তাদের আনিত অনুযোগ, অভিযোগ, দুঃখদুর্দশা ও সমস্যার কথা এবং সমস্যার সমাধান দিই। আবদার থাকলে তাও মেটাই। তাদের খুশি রাখার জন্য যা যা করার প্রয়োজন তাই করার চেষ্টা করি।
একেক মিলনমেলায় একেক প্রজাতির অনুযোগ অভিযোগ শুনি। সমস্যার সমাধান দিই। সেই পালাক্রমে এবারের মিলনমেলায় পাখি প্রজাতির অনুযোগ, অভিযোগ, দুঃখদুর্দশার কথা শোনা হবে। সমাধানও দেওয়া হবে।
এইতো কিছুক্ষণ আগে শেষ হলো ভোজনপর্ব। সবাই জমিনে গা এলিয়ে দিয়ে একটু বিশ্রাম নিচ্ছিল। এরমধ্যে শিয়াল উজির অনুযোগ-অভিযোগ পর্বের ঘণ্টা বাজিয়ে দিলো। পাখিদের মধ্যে প্রথম আমার সিংহাসনের সামনে এসে দাঁড়ালো ময়না পাখি।
আমি বললাম, ময়না বলো কী অভিযোগ তোমার?
ময়না বলল, রাজামশাই আমার কোনো অভিযোগ নাই। আছে শুধু একটা দুঃখ।
আমি বললাম, কী দুঃখ তোমার?
ময়না বলল, আমাদের দেশের তো স্বাধীনতা দিবস, বিজয় দিবস আছে। এমনিভাবে আছে একুশে ফেব্রুয়ারি–ভাষা দিবস। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। এই ভাষা কি শুধু মানুষ জাতির আছে? আমরা পাখি বলে কি আমাদের স্বাধীনতা নেই, আনন্দ উল্লাস নেই, নিজস্ব ভাষা নেই?
আমি বললাম, কেন নেই, অবশ্যই আছে। তোমাদেরও স্বাধীনতা আছে। আনন্দ-উল্লাসে মেতে ওঠার অধিকার আছে । আছে তোমাদের নিজস্ব ভাষাও। আছে তোমাদের মাতৃভাষা।
ময়না বলল, আমাদের যদি স্বাধীনতা থাকে, থাকে যদি আমাদের নিজস্ব ভাষা, তাহলে মানুষ জাতি কেন আমাদের স্বাধীনতা হরণ করে বন্দী করে। বন্দী করে জোরপূর্বক তাদের ভাষা কেন আমাদের শেখাতে চায়? কেন তাদের মাতৃভাষা আমাদের উপর জোরপূর্বক চাপিয়ে দিতে চায়?
ময়না একটু থেমে ফের বলতে থাকল,
আমার স্বামীকে মানুষ জাতি বন্দী করে রেখেছে ছ’মাস হতে চলল। মাঝেমধ্যে ওই বাড়িতে গিয়ে খাঁচায় বন্দী স্বামীকে দেখে আসি। কিন্তু মাসখানেক হলো তিনি আমার সাথে কথা বলতে পারছেন না। তিনি আমাদের ভাষা ভুলে গেছেন। তাকে মানুষ জাতি খাঁচায় বন্দী করে জোর করে তাদের মাতৃভাষা বাংলা শিখিয়ে দিয়েছে। রাজামশাই আমি এর বিচার চাই!
আমি আমার সিংহাসন থেকে উঠে দাঁড়ালাম। তার কথায় ব্যথিত হলাম। কিন্তু ময়নাকে সান্ত্বনা দেওয়ার মতো কোনো ভাষা খুঁজে পেলাম না।
এরপর শালিক, টিয়ে এক-এক করে তাদের অভিযোগ ও দুঃখের কথা বলতে লাগল। তাদের আজ একটাই অভিযোগ, তোমরা মানুষ জাতি পাখিদের জোরপূর্বক বন্দী করে তোমাদের মাতৃভাষা বাংলা শিখিয়ে দাও।
এমনটা কেন করো তোমরা?
আর ঘুঘু তো কেঁদেই ফেলল। চোখের জল মুছতে মুছতে ঘুঘু বলল,
আমার ছেলেকে মানুষ জাতি বন্দি করে নিয়েছে। রাজামশাই, আমরা এর থেকে পরিত্রাণ চাই। স্বাধীন হয়ে মুক্ত আকাশে উড়তে চাই। আমাদের মায়ের ভাষায় কথা বলতে চাই।
হে মানুষ জাতি, শুনলে তো পাখিদের দুঃখ বেদনার কথা। তারা তাদের রাজার কাছে অভিযোগ করেছে। তাদের দুঃখের কথা জানিয়েছে। কিন্তু আমি কিছুই করতে পারলাম না।
আমি তাদের রাজা হয়ে তোমাদের কাছে আবেদন জানাচ্ছি, তোমরা পশুপাখিদের স্বাধীনতা কেড়ে নেওয়া থেকে বিরত থাকবে। তাদের খাঁচায় বন্দী না করে স্বাধীনভাবে আকাশে উড়তে দেবে। তাদের নিজস্ব ভাষা, মাতৃভাষায় কথা বলায় বাধা হতে পারে, এমন যাবতীয় কর্মকাণ্ড করা থেকে নিজেদের বিরত রাখবে। তাদেরও স্বাধীনভাবে ডানা ঝাপটিয়ে মুক্ত আকাশে ওড়ার স্বাধীনতা আছে। অধিকার আছে তাদের মায়ের ভাষায় কথা বলা, গালগল্পে মেতে ওঠার। পশুপাখিদের স্বাধীনতা হরণ করার কোনো অধিকার তোমাদের নেই।
পাঠকদের মন্তব্য
250