বন্ধুত্ব
লেখক : জয়ন্ত কাডদেওর (কন্নড়)
অনুবাদ : শ্যামল ভট্টাচাৰ্য
মকর সংক্রান্তির দিন৷ শ্রী বিবেকানন্দ স্কুলের ছাত্ররা বনভোজনে যাচ্ছে৷ কৃষ্ণা নদীর সেতু পেরিয়ে ওপারে গিয়ে, নদীতীরের আল ধরে শেষে তারা সিদ্ধেগৌড়ার বাগানে পৌঁছয়৷ সেখানে প্রচুর আম আর কলাগাছ৷ ছেলেরা একটা আমগাছের নিচে এসে দাঁড়ায়৷
“স্যার,কি চমৎকার গাছের ছায়া”–জগদীশ বলে, “কেমন ঠান্ডা! এখানেই খাওয়াদাওয়া করব”–যোগ করে সে। স্কুলের কন্নড় ভাষার মাস্টারমশাই গিরিয়াপ্পা ছাত্রদের সঙ্গে এসেছেন। তিনি বলেন, “ঠিক আছে,এখানেই বসব ৷ জানো, এই আমগাছটি নিয়ে খুব সুন্দর একটি গল্প আছে। তোমরা সবাই স্নান সেরে এসো।খাওয়ার পর গল্প শোনাবো৷”
গল্পের নামে বাচ্চারা লাফিয়ে ওঠে৷ যত তাড়াতাড়ি হয়, নদীতে স্নানটান করে তারা চলে আসে৷ খিদেয় তখন তাদের পেটে ইঁদুর দৌড়চ্ছে৷ তাই চটপট খাওয়া শেষ করে নেয়৷ আসলে গল্প শুনতে তারা মুখিয়ে আছে৷
“বাচ্চারা, এখন বন্ধুত্ব নিয়ে একটা গল্প শোনাব৷ মানুষে মানুষে যে ভালোবাসার সম্পর্ক, তার গল্প৷ মন আর হৃদয়ের গল্প৷ শুরু করি?”
মাস্টারমশায়ের কথায় সব বাচ্চা সমম্বরে চেঁচায়, “বলুন, আমরা অপেক্ষা করছি৷”
মাস্টারমশাই শুরু করেন–
তাহলে শোনো! এই গাঁয়ে দুটি ছেলে ছিল—হাসান বেয়ারি আর শশীকান্ত চৌহান। দুজনে একই পাঠশালায় পড়ত৷ শশীকান্তর চেয়ে হাসান বছর চারেকের বড় ৷ লেখাপড়ায় বেশ তুখোড় হলেও তারা ভীষণ গরিব৷ তার বাবা হানিফ ছাড়া নিজের বলতে হাসানের আর কেউ নেই৷ হানিফ সিদ্ধগৌড়ার কাছে কাজ করতেন৷ বাবাকে সাহায্য করার সঙ্গে সঙ্গে হাসান পড়াশোনাও করত ৷ বুদ্ধিমান পরিশ্রমী বলে সে কলেজেও ভর্তি হয়। ছুটিতে ক্ষেতখামারে কাজ করে মজুরির পয়সা জমিয়ে হাসান ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে শহরে যায়। কোনোমতে একবেলা খেত আর একটা দোকানের সামনের সিঁড়িতে ঘুমাত। দয়া করে শোয়ার জায়গাটুকু দিয়েছিল বলে দোকানটা সে ঝাঁট দিয়ে দিত ৷ এতসব বাধাবিপত্তি সত্ত্বেও হাসান লেখাপড়ায় বরাবরের সেরা!
শশিকান্তও হাসানের মতো মেধাবী৷ সে বাবা-মায়ের একমাত্র সন্তান৷ তার বাবা ছিলেন ধনী। কার্পাস তুলোর ব্যবসায়ী৷ আশপাশের গ্রাম থেকে কার্পাস কিনে আহমেদাবাদ, সুরাটের মিলে চালান দিতেন৷ ডাক্তারি পড়ার সুযোগ পেয়ে শশীও শহরে আসে৷ বাস টার্মিনাসে দেখে, তল্পিতল্পা গুটিয়ে হাসান গ্রামে ফিরছে ৷ “আরে হাসান, কি ব্যাপার? তুমি গাঁয়ে যাচ্ছ?”–শশিকান্ত জিজ্ঞাসা করে।
“আমি এবছর আর পড়ব না। জানোই তো বাবা মারা গেছেন৷ কলেজের খরচ চালানোর মতো টাকা নেই৷ একটু কাজকর্ম করে টাকা পয়সা জমিয়ে আগামী বছর আবার আসব”–জবাবে হাসান বলে।
ঘটনাটা শশীর মনে পড়ে৷ দুমাস আগে কৃষ্ণায় বান এসেছিল৷ হাসানের বাবা তাতেই ভেসে গেছেন ৷ সবকিছু হারিয়ে হাসান এখন নিঃস্ব৷ তার বাবা যে কুঁড়েতে থাকতেন, সেখানে হাসান একটা আমের চারা পুঁতেছে৷ ওখানে বাবা যে ঘাম ঝরিয়েছেন, সেই স্মৃতি থাকুক–এটাই তার ইচ্ছা।
“দেখো হাসান, একটা কথা বলি৷ খারাপ ভাবে নিও না৷ এবছর আমি তোমাকে সম্পূর্ণ সহযোগিতা করতে চাই৷ আমার গ্রাম, আমার ভাইয়ের উন্নতি করাই আমার লক্ষ্য”–বলতে বলতে শশীকান্ত তার দুটো হাত চেপে ধরে৷
'”না, না শশী। এত বড় দায়িত্ব তোমার ওপর চাপাব না৷ তোমার বাবা কি বলবেন? তুমি কে আর আমি…? তোমাকে এমন কষ্ট দিতে চাই না”–হাসান শশীকান্তকে বোঝানোর চেষ্টা করে৷
“আমরা দুজনে একই গাঁয়ে জন্মেছি৷ এছাড়া আর কোনো সম্পর্কের কি দরকার? তুমি আমার সঙ্গে চলো”–হাসানকে টেনে নিয়ে যায় শশী৷
হাসান বাধ্য হয়ে শশীকান্তর ঘরে থাকতে শুরু করে৷ শশীই তার কলেজের খরচপত্র দেয়৷ একমাত্র ছেলের সঙ্গে দেখা করতে এসে শশীকান্তর বাবা-মা আশীর্বাদ করে গেলেন, ভাইয়ের মত মিলেমিশে থেকে দুজনে লেখাপড়া করো ৷
প্রথম শ্রেনীতে পাস করে হাসান বায়ুসেনায় যোগ দেয়৷ গাঁয়ে গেলেই সে সিদ্ধগৌড়ার ক্ষেতে বাবার স্মৃতিতে লাগানো আম গাছের নিচে বসে৷ শশীকান্তর বাবা-মায়ের সঙ্গেও দেখাসাক্ষাৎ করে৷
শশী যখন ডাক্তারির শেষ বছরের ছাত্র, তখন হাসানের বিয়ে হয়৷ সেই উপলক্ষে তার বাবা-মাকে হাসান বেঙ্গালুরু নিয়ে যায়৷ এঁরা আমার মা-বাবা–সেখানে পরিচিত লোকজনের সঙ্গে এভাবেই তাঁদের পরিচয় করায়৷
বিয়ের আনন্দ অনুষ্ঠান সেরে শশীকান্তর বাবা-মা বাড়ি ফিরলে চৌহান পরিবারে এক বিরাট দুর্ঘটনা ঘটে৷ আগুন লেগে শশীকান্তর বাবার বস্তা বস্তা কার্পাস ছাই হয়ে যায়৷ এই খবরে তিনি মনে খুব আঘাত পেলেন৷ শেষে স্ট্রোক হয়ে হাসপাতালেই মারা যান৷ যারা তাঁর থেকে ধার নিয়েছিল, এই ঘটনার পর তারা কেউই শশীকে টাকা শোধ দেয় না। বরং পাওনাদাররা নিজেদের ঋণ আদায় করতে আসে৷ সেসব মেটাতে গিয়ে তাদের দোকান, বাড়ি সব নিলামে ওঠে৷ শশীকান্তর কাকারাই সব কিছু কিনে নেয়৷ বাড়িঘর বিষয়সম্পত্তি সমস্ত খুইয়ে শশী এখন অনাথ৷
এরপর সে মায়ের সঙ্গে শহরে এসে ঘর ভাড়া নেয়৷ তবে নিজের এই দুরবস্থার কথা হাসানকে কিচ্ছুটি জানায়নি শশীকান্ত৷ সত্যি বলতে কি, বহুদিন পর্যন্ত হাসান এসবের বিন্দুমাত্র টের পায়নি৷ বরং আগের মতোই চারদিনের ছুটি নিয়ে বাড়ি ফিরে সোজা সেই আমগাছের কাছে আসে৷ বাবার পরিশ্রম,কষ্টের দিন এসব নিয়ে সে ভাবে। তিনি তার উন্নতি দেখে যেতে পারেননি,কথাটা মনে করে কাঁদে। চৌহানরাই আমার বাবা-মা, ওরা গাঁয়ে আছে–বলে নিজেকে সান্ত্বনা দেয়।
হাসানকে দেখে গাঁয়ের সবাই কেমন করে যেন তাকায়৷ সেই চাউনির মানে সে বুঝতে পারে না৷ শশীকান্তর বাড়িতে গিয়ে জানতে পারে, সেখানে অন্য লোক থাকে৷ সব শুনে প্রচন্ড দুঃখে সে শিশুর মত কেঁদে ফেলে৷ মায়ের সঙ্গে শশী শহরেই কোথাও রয়েছে জেনে হাসান তাড়াতাড়ি শহরে ফিরে আসে৷ শহরে এসে সোজা কলেজে গিয়ে সে শশীকান্তর সঙ্গে দেখা করে৷ মায়ের কাছেও যায়, বাবার জন্য অঝোরে কাঁদে। শশী এতদিন কিছু বলেনি কেন, তা নিয়ে ভীষণ রাগারাগি করে৷
“তোমার পরীক্ষা এখনো শেষ হয়নি ৷ তাই মা এখন আমার সঙ্গে বেঙ্গালুরু যাবে৷ পরীক্ষার এখনো পাঁচ মাস বাকি৷ নাও,এটা রাখো”–শশীকান্তর হাতে হাসান কিছু টাকা গুঁজে দেয়৷
“বাবা হাসান! ভেবেছিলাম আমাদের খোঁজখবর নেওয়ার কেউ নেই৷ আমরা অনাথ৷ আনন্দে, খুশিতে গদগদ হয়ে শশীর মা বলেন, “তুই তা মিথ্যে প্রমাণ করে দিলি ৷ আমি তোর কাছে গিয়ে কিছুদিন থাকব। বউমাও আছে। তারপর শশীর কাছে আসব৷ কাল বেঙ্গালুরু যাব। এখন ওঠ। খেতে আয়৷” দুই বন্ধু খেতে বসে৷
গিরিআপ্পা মাস্টারমশায়ের গল্প শুনে চোখ ভরা জল নিয়ে বাচ্চারা বলে, “এই না হলে বন্ধুত্ব!”
পাঠকদের মন্তব্য
250