বন্দী বাতাসের রূপকথা
অনুবাদ : জ্যোতির্ময় দাশ
(জাপানি লোককথা)
আমরা অনেকেই জাপানি হাতপাখা দেখেছি। ছ’ইঞ্চি থেকে আট ইঞ্চি লম্বা আর এক ইঞ্চি চওড়া দুটি পাতলা কাঠের মধ্যে ভাঁজ করা শক্ত কাগজ বা সিল্ক কাপড়ের গায়ে ছবি আঁকা পাখা। পাতলা কাঠ দুটি ছড়িয়ে ধরলেই ১৮০ ডিগ্রি হয়ে আধখানা চাঁদের মতো এক পাখা হয়ে যায়। সেই হাতপাখা দিয়ে গরমের দিনে ট্রামে-বাসে-ট্রেনে অনেকেই হাওয়া খান। এই হাতপাখার মধ্যে বাতাসকে বন্দী করে রাখার সুন্দর একটি জাপানি লোককথার কাহিনি লুকিয়ে আছে। জাপানের সকলে এটাকে সত্যি ঘটনা বলেই বিশ্বাস করে। সত্যি ঘটনাটাই চলে আসতে আসতে শেষে লোককথা হয়ে যায় একসময়।
অনেকদিন আগে জাপানের এক রাজা তাঁর ছেলের বিয়ের জন্য পাত্রী খুঁজছিলেন। রাজপুত্রের সঙ্গে বিয়ে হবে শুনে রাজ্যের সব কুমারী মেয়ের বাবা-মা তাঁদের মেয়েদের নিয়ে রাজসভায় উপস্থিত হলো।
রাজা জানালেন, তিনি তাঁর ছেলের জন্যে এমন মেয়ে খুঁজছেন, যাকে দেখতে-শুনতে একটু ভালো তো হতেই হবে, কিন্তু তার থেকেও বড়ো কথা হল তাকে বুদ্ধিমতী হতে হবে! বুদ্ধির পরীক্ষার জন্য রাজা তিনটি কাজ করার কথা বলেছিলেন। সে কাজ যে মেয়েটিকে একা একা করতে হবে তেমন কোনো শর্ত নেই—ইচ্ছে করলে মেয়েটি বড়োদেরও সাহায্য নিতে পারে।
সেই তিনটি কাজ হল–
এক : নদী থেকে হাতের মুঠোয় করে জল আনতে হবে, কিন্তু আনবার সময় একফোঁটা জলও যেন আঙুলের ফাঁক গলে পথে না পড়ে যায়!
দুই : কাগজের পাত্রে করে আগুন আনতে হবে, কিন্তু কাগজ এতটুকু পুড়লে চলবে না!
তিন : বাতাসকে সবসময়ের জন্যে বন্দি করে রাখতে হবে, যেন তাকে খুশিমতো ডাকলেই সবসময় হাতের কাছে পাওয়া যায়!
রাজসভায় যেসব সুন্দরী মেয়েরা এসেছিল, তারা আর তাদের মা-বাবারা কেউ-ই তিনটে কাজ কী করে করা যাবে ভেবে ভেবে কিছুই ঠিক করে উঠতে পারল না। শেষে সকলেই নিরাশ হয়ে বাড়ি ফিরে গেল। কারোর আর রাজপুত্রের কনে হওয়া হলো না!
শহরের শেষ প্রান্তে এক প্রাচীন প্যাগোডায় (জাপানের বুদ্ধ মন্দির) এক বৃদ্ধ পুরোহিত থাকতেন। সেই পুরোহিতের এক মেয়ে ছিল। সকলে তার বুদ্ধির খুব প্রশংসা করত। পুরোহিতের মেয়ে দেখতেও রূপবতী। কিন্তু তারা খুব গরিব ছিল বলে রাজার সভায় যায়নি। রাজার কানে সেই মেয়ের খবর পৌঁছতে, তিনি মন্ত্রীকে বললেন, পুরোহিতের মেয়েকে এক্ষুনি এনে হাজির করতে। রাজামশাইদের কোনো কাজে দেরি হওয়া একটুও সহ্য হয় না। মেয়েটি রাজার তিনটি কাজের পরীক্ষার কথা শুনেছিল। রাজার পেয়াদাকে সে জানালো তিনদিন পরে সে রাজার সঙ্গে দেখা করবে। আর রাজার জন্যে তিনটি জিনিসই নিয়ে যাবে।
রাজা শুনে অবাক হলেন। রাজসভায় পাত্র-মিত্র সকলে আশ্চর্য হলো। সারা শহরের সবাই পুরোহিতের মেয়ের কথা শুনল। তারা সকলেই জিনিস তিনটে দেখার জন্যে রাজসভায় যাবে ঠিক করল।
ঠিক তিনদিন পরে পুরোহিতের মেয়ে রাজার সঙ্গে দেখা করতে গেল। রাজসভায় সেদিন প্রচুর ভিড়। এতটুকুও খালি জায়গা নেই। রাজা জিনিস তিনটির কথা জিজ্ঞাসা করতেই মেয়েটি ওড়নার আড়াল থেকে একমুঠো বরফ রাজাকে দিয়ে জানালো, যে সেটা নদীর জল দিয়ে তৈরি এবং হাতে করে সেটা আনবার সময় একফোঁটা জলও রাস্তায় পড়েনি।
তারপর রঙিন কাগজ দিয়ে তৈরি সুন্দর একটা লণ্ঠন বার করে তার মধ্যে রাখা একটি মোমবাতি জ্বালিয়ে দিয়ে জানালো যে কাগজের সেই পাত্র করে জ্বলন্ত আগুনকে যেখানে খুশি নিয়ে যাওয়া যাবে। কিন্তু কাগজের লণ্ঠন মোটেও পুড়বে না। আর সবশেষে চমৎকার একটি নক্সা-আঁকা জাপানি হাতপাখা বার করে রাজার হাতে দিয়ে বলল, যে সেই কাগজের পাখার মধ্যে বাতাসকে চিরকালের জন্য বন্দী করে রাখা হয়েছে। পাখা খুলে নাড়ালেই বাতাসকে সবসময়ে অনুভব করা যাবে। ইচ্ছেমতো যখন খুশি, যতবার খুশি।
পরীক্ষার কথা বলার সময় তার এমন যে সমাধান সম্ভব হবে, রাজা নিজেই সেটা জানতেন কিনা, সেকথা জানার আজ আর কোনো উপায় নেই। তিনি খুশি হয়ে গরিব পুরোহিতের মেয়ের সঙ্গে রাজপুত্রের বিয়ে দিলেন!
সেই থেকে জাপানের সব উৎসবে রঙিন কাগজের লণ্ঠন দিয়ে বাড়ি-ঘর-মণ্ডপ সাজানো হয়। আর জাপানের সব মেয়েরা তাদের কাছে জাপানি হাতপাখা রেখে দেয় সৌভাগ্যের নিদর্শন হিসেবে।
পাঠকদের মন্তব্য
250