ছোটোদের চাঁদের হাসি / ছড়া - কবিতা / নভেম্বর ২০২৩

শ্রদ্ধাঞ্জলি

ঘড়ি বলে

নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী

 

টিক টিক বেজে যায় দেয়ালের ঘড়ি,

যত তাকে দেখি তত হায়-হায় করি।

ভাবি কত কাজ পড়ে রয়েছে এখনও

এ-দিকে সে-দিকে, তবু  হুঁশ নেই কোনো।

সময়ে করিনি, তাই দূরে আর কাছে

হাজার জরুরি কাজ ‌ডাই হয়ে আছে।

জবাব লিখিনি, তাই টেবিলের পরে

ক্রমেই জমেছে ধুলো চিঠিপত্তরে।

 

ঘড়ি বলে, 'এ তো মোটে ভালো কথা নয়,

মিনিটে,মিনিটে চলে যাচ্ছে সময়।

সেটা যে বোঝে না, তাকে বলতে হবেই,

"হায়-হায়,‌ সময় তো আর বাকি নেই।

তাই বলি,আলসেমি-ভূতকে তাড়াও,

কাজে মন দাও ভাই, এক্ষুনি দাও।"

 

***প্রথম বর্ষ, বিশেষ সংখ্যা

 

 

প্রশ্নোত্তর

সমরেন্দ্র সেনগুপ্ত

 

কাপড়ে লাগালে তালি বলা হয় রিপু,

হাততালি দিলে কেউ কি বলবো দীপু ?

বল দীপু বলে ফ্যাল চট করে বলতো

আশ্বিনে মেঘ কেন ঝুলে থাকে আলতো!

টিকটিকি ঠিক ঠিকই ঝোলে কেন দেয়ালে

কেন বা কখন ডাকে রাশি ফল মেলালে।

জয় বাবু লেখেন না কেন ছোটো কবিতা

জানলে তা বলে ফ্যাল করিস না ভনিতা,

দিনরাত ভুল স্কেলে গায় কেন রাস্কেল

পরীক্ষা না দিয়ে কেন করে কেউ ডাহা ফেল।

ক' হাজার মন্ত্র জেনে হয় মন্ত্রী

ষাঁড় কেন ক্ষেপে গেলে হয় ষড়যন্ত্রী।

মনুমেন্ট প্রতি সনে হয় কত উচ্চ

কোন কোন কেতাবে তা আছে সেটা উহ্য ?

–এসব জানতে হলে হে বালক দীপু রায়

নিকটে গড়িয়ে আয়, থাকি আমি গড়িয়ায়।

 

***প্রথম বর্ষ,বিশেষ সংখ্যা

 

 

আবহাওয়া

অরুণকুমার বসু

 

আলিপুরে থাকে এক আবহাওয়া-বিশারদ

জলবায়ু বলে যান কি বরষা, কী শারদ

আগাম খবরে চোখ বন্যা কি খরাতে

ভালো না মন্দ আছে এ-দেশের বরাতে।

'দুদিন বৃষ্টিপাত হবে না এ-বঙ্গে',

সকলে সে কথা শুনে ছাতা নেয় সঙ্গে।

যদি শোনে, 'বৃষ্টির আছে সম্ভাবনা',

তাহলে অফিসে আজ ছাতা নিয়ে যাস না।

–এ কথা সবাই জানে। কোনো কথা ফলে না।

 কারণ 'বৃষ্টি' 'ঝড়' কোনোটাই মেলে না।

 বলেন, 'সতেরো ফিট কোটালের হবে বান',

 শুনে নিশ্চিন্তে ঘুমোতেই সবে যান।

 যেদিন বলেন, 'বান আসবে না আহা', আর–

 সেদিনই বানের ভয়ে ঘরে ঘরে হাহাকার ।

 

***শারদ ২০১০

 

 

প্রজাপতি

মৃণাল বসুচৌধুরী

 

হঠাৎ সেদিন দুপুর বেলা

         একটা প্রজাপতি,

 জানলা থেকে, চাইল ঘরে

ওড়ার অনুমতি ;

             আমার দিকে তাকিয়ে বলল–

ভীষণ খারাপ মন

  কেমন যেন গন্ধবিহীন

 লাল গোলাপের বন,

     তোমরা সবাই ব্যস্ত ভীষণ

     দ্যাখো না মুখ তুলে–

      উদাস বাগান কেমন সাজে

রংবেরঙের ফুলে,

      রামধনু রং আকাশ জুড়ে

উড়ছে রঙিন পরী

   সদ্যকাটা ধানের ভারে

   দুলছে সোনার তরী,

      এসব দেখার সময় কোথায়

মগ্ন যে যার কাজে

      প্রকৃতি রোজ তোমার জন্যে

সাজছে নতুন সাজে

     চলো এবার বাইরে বেরোও

মুক্ত হাওয়ার টানে

                      অনন্ত এই বিশ্বটাকে

একটু রাখো প্রাণে।

 

***শারদ ২০১০

 

 

আমাদের কলকাতা

     রাণা চট্টোপাধ্যায়

 

    আমাদের কলকাতা কাশ্ তে-কাশ্ তে

    বদলায় প্রতিদিন আস্ তে-আস্ তে ।

    দাদু যদি ফিরে এসে দেখেন শহর

    চিনতে কি পারবেন স্ফীত এ বহর ?

    বিধাননগর থেকে বাইপাস ধরে

    দাদু যান একা-একা পাটুলিও-গ'ড়ে।

    অবাক বিস্ময়ে দেখেন রাশি রাশি বাড়ি

    কবে হল মুছে দিয়ে ধাপা মেছো-ভেড়ি ?

    কাশীপুর দমদম বিটি রোড ছাড়িয়ে

    পথঘাট খানাডোবা কবে গেল হারিয়ে ?

    মাটির নিচেতে ছোটে স্বপ্নের রেল

    এদিকে-সেদিকে সেতু তাজ্জব খেল।

    সেই ছবিঘরগুলি সেই নাটশালা

    নেই কেন দাদুদের চিৎপুর পালা ?

    অনেক বনেদীবাড়ি ভেঙেচুরে প্রোমোটার

    বানিয়েছে ফ্ল্যাটবাড়ি থাম নেই কোনোটার।

 

    তাদের চিহ্নগুলি ধুয়ে মুছে আমরা

    শিশু-বুড়ো বেশ আছি দু'ঘরের কামরা ৷

    কালীঘাট, বালিগঞ্জ, বাইপাস ছাড়িয়ে

    কলকাতা বেড়ে চলে ডালপালা ছড়িয়ে ৷

    ভূত-প্রেত, পোড়োবাড়ি ভয়-ভয় মনটা

    কবে যে উধাও হল আকাশের কোণটা!

    মেঘে-মেঘে ঢোকাঠুকি, রামধনু নীলাকাশ

    একটু বৃষ্টি হলে চলত না ট্রাম-বাস

    দাদু ভাবে মরে গেছি কবে কে তা জানে

    সব স্মৃতি হারিয়েছে মন কি তা মানে ?

    আড্ডার রকগুলি আজও যদি থাকতো।

    নিশ্চয়ই কলকাতা আমাদের ডাকতো ।

 

    ***শারদ ২০০৬

 

 

আমার তখন বালক বয়স

অপূর্ব দত্ত

 

দুরন্ত এক বালকবেলা, বিস্মৃতপ্রায় ছবি

হাতের মুঠোয় ঝরা-বকুল, মঞ্চে বিশ্বকবি ; 

ভরাট গলায় মা গাইছে কবির প্রিয় গান—

'আকাশভরা সূর্য-তারা, বিশ্বভরা প্রাণ'৷

 

মিলিয়ে যাওয়া ঘুড়ির মতোই আবছা মনে পড়ে

হেমনলিনী বিদ্যালয়ের একতলার হলঘরে

পাঁচ-ছটা হাই-বেঞ্চি জুড়ে সাদা ফরাস পাতা

মধ্যিখানে মা বসেছে, হাতে গানের খাতা।

 

দোয়ারকিনের হারমোনিয়াম, তানপুরাতে তান একটার-পর-একটা শুধু কবিগুরুর গান ;

মাঠের মতন ঘরটা সেদিন লোকে লোকারণ্য

আমার তখন বালক বয়স, বুঝিনি একবর্ণ I

 

আজকে যখন সে-গান শুনি অবসরের ফাঁকে

মন ছুটে যায় বালকবেলার পঁচিশে বৈশাখে ; দেয়ালে দুই ছবির দিকে তাকিয়ে থাকি ঠায়

নীল নীলিমার নিঃসীমতায় কাঁদতে ভুলে যাই ৷

 

***জানুয়ারি ২০০৮

 

 

সুখের ঠিকানা

দীপ মুখোপাধ্যায়

 

মেঘ হয়ে তুমি ভাসতে ভাসতে

যদি কোনোদিন এখানে আসতে 

ঢেউ আঁকা দীঘি ঘাসপাতা দেখে

              পেতে জীবনের ছন্দ,

দুপুরের রোদে কিংবা বিকেলে

ছুটে চলে যেতে সবকিছু ফেলে

যেখানে বাতাসে ছড়িয়ে রয়েছে

               বকুল ফুলের গন্ধ ৷

স্নেহের আঁচলে শেকড়ে-বাকড়ে

লাউ ফলে থাকা এক খোড়োঘরে

সুখের ঠিকানা খুঁজে নিতে গিয়ে

              চোখে এলোমেলো দৃষ্টি,

সূয্যি তখনো রাঙা টলটলে

গড়াগড়ি দেবে পুকুরের জলে

তোমার স্বপ্ন-তৃষ্ণা মেটাবে

                 শুধু একফোঁটা বৃষ্টি।

 

***শারদ ২০১৩

 

 

সমুদ্র সৈকতে

মৃত্যুঞ্জয় কুন্ডু

 

সূর্য ছড়ায় কুসুম রাঙা আলো

        সাধ্য কি আর চোখ ফিরিয়ে থাকি ৷

 ক্রমেই দেখি যায় পালিয়ে দূরে

          রাত-জাগা সেই কালো ডানার পাখি।

 

সামনে তখন স্নিগ্ধ বালুর চর

       ঢেউয়ের সাথে করছে কোলাকুলি।

 সমুদ্র আর আকাশ মাখামাখি

    সাদা মেঘের হাতে রঙের তুলি ৷

 

     জলপাহাড়ে আটকে থাকে চোখ

 ধুনছে তুলো লক্ষ কারিগরে ৷

      পায়ের পাতা ভিজিয়ে দিতে এসে

        জলসেনারা হাজার সেলাম করে ।

 

 ফিসফিসিয়ে বলছে যেন কথা

    ঝাউপাতারা হাওয়ায় দুলে দুলে,

                  রৌদ্র এসে পরায় জরির ফিতে

       হালকা মেঘের আলগা বাঁধা চুলে ৷

 

   ভোরের বাতাস গুনগুনিয়ে ওঠে

                  কন্ঠে সবার আনন্দ ভৈরবী ৷

                  বয়স হারায় সমুদ্র সৈকতে

                  সবাই যেন হঠাৎ করে কবি ৷

 

                   ***শারদ ২০১০

 

 

গাছকে ভালোবাসো

সনৎ বসু

 

                    বাঁচতে যদি চাও গো মানুষ        

গাছকে ভালোবাসো—--

 যতই উড়াও জ্ঞানের ফানুস

                      খুশির ভেলায় ভাসো।

    ছাড় পাবে না, ছাড় পাবে না

      গাছ কেটে কেউ পার পাবে না

                     নিজের পায়ে কুড়ুল মেরে

                         মরণ-বিষে কাশো

                         গাছকে ভালোবাসো ৷

 

  গাছ তো সবার বন্ধু, ভ্রাতা

                      জীবনদাতা, ধাত্রীমাতা,

 গাছই তো সেই পরিত্রাতা

                          এই পৃথিবীর শ্বাসও,

                          গাছকে ভালোবাসো ৷

 

গলা ছেড়ে গাও হে গান

      'একটি গাছ–হরেক প্রাণ'

                       গাছই করে গরল পান

                            বায়ুর দূষণ নাশও,

                            গাছকে ভালোবাসো৷

 

  বলছি শোনো, বন্ধুজনও

  সবাই মিলে সবুজ বোনো

 সবুজ ঘাসে ভরাও মাটি

                              সবুজ মনে হাসো

                              গাছকে ভালোবাসো৷

 

                       ***এপ্রিল ২০০৮

 

 

মনস্বিনীর জন্যে

রাখাল বিশ্বাস

 

       তুমি জীবন রঙের পাখি

       তুমি নীলিমায় ডাকাডাকি

       তুমি চাঁদের হাসির মুখ

       তুমি অনন্ত কৌতুক

       তুমি ধূসরগোধূলি বেলা

       তুমি কুসুমে কুসুমে খেলা

       তুমি কালপুরুষের বুকে

       তুমি রেখেছিলে সব টুকে

       তুমি ছোট্টবেলার সুর

       তুমি জানালার রোদ্দুর

       তুমি প্রজাপতি ডানা মেলে

       তুমি আগুন দিয়েছো জ্বেলে

       তুমি দুই মলাটের মধ্যে

       তুমি স্বপ্ন দেখেছো পদ্যে

       তুমি ময়নামতির চর

       তুমি সুন্দরে সুন্দর

       তুমি জন্মদিনের হাওয়া

       শুধু আমার হল না যাওয়া…

 

***জানুয়ারি ২০১০





ছড়া ও কবিতা

মেঘের ছবি

অশোককুমার মিত্র

 

আকাশ ছিল ফুল ছড়ানো

                            এখন ফুলের তোড়া,

তার পিছনে ছুটেছে বটে

                             দুলকি চালের ঘোড়া।

ঘোড়া তো নয় ,মেঘের বুকে

                             চলছে ভেসে নৌকো

নীল আকাশে পেঁজা তুলোর ,

                           মেঘ হল ফের চৌকো।

ঘুড়ির মতো ডাক ঘুড়ি এক

                                 দূরের পানে পাড়ি ,

তেপান্তরের মাঠের শেষে

                               ঝুপসি গাছের সারি ।

মেঘ এবারে গাছের মাথায়

                                  নীল চাঁদোয়া পাতা ,

তার নিচে ঠিক ব্যস্ত শহর

                                     ছুটন্ত কলকাতা ।

মেঘ হল ফের  কাকাতুয়া

                                  মাথায় ছোট ঝুঁটি,

বলছে ,দেখো শরৎ এলো

                                 এবার পুজোর ছুটি।

 

 

স্বপ্নে আমি পা বাড়ালাম

শ্যামলকান্তি দাশ

 

ঠিক জানি না কোন মুলুকে

কোথায় দেব পাড়ি,

দরজা খুলে দাঁড়িয়ে আছে

নিরুদ্দেশের বাড়ি।

 

যাচ্ছি নতুন গানের কাছে

চিরকালের সুরে,

পথের ধারে চাঁদ কুড়োতে

ছোটবকুল পুরে৷

 

যাচ্ছি এবার সুদূর বনে

পাহাড়ে আর মেঘে,

ঠিক সময়ে ফিরবো বাড়ি

থেকো না উদ্বেগে৷

 

এবার কোথাও হবেই যেতে

ছুটির ফাঁকে ফাঁকে,

স্বপ্নে আমি পা বাড়ালাম

নীল আকাশের ডাকে৷


পাঠকদের মন্তব্য

শ্যামল ভট্টাচার্য লিখেছেন... ০৯ই ডিসেম্বর, ২০২৩
ছোটোদের উপযোগী অত্যন্ত সমৃদ্ধ সাহিত্যপত্র। ভালো লেগেছে।

আপনি কি এই লেখায় আপনার মন্তব্য দিতে চান? তাহলে নিচে প্রদেয় ফর্মটিতে আপনার নাম, ই-মেইল ও আপনার মন্তব্য লিখে আমাদের পাঠিয়ে দিন।
নাম
ই-মেইল
মন্তব্য

250

    keyboard_arrow_up